রেলের এক লাইনে চলে যে যান

রেললাইন মানেই একজোড়া লাইন। কিন্তু জার্মান প্রকৌশলীরা একটি যান তৈরি করেছেন, যেটি রেললাইনের একটি লাইন ব্যবহার করে চলে। কয়েক বছরের মধ্যে এর ব্যবহার শুরু হতে পারে।
ব্যাটারিচালিত এই বাহনকে মনোক্যাব নামে ডাকা হচ্ছে। অ্যাপ দিয়ে একে পছন্দের স্টপেজে থামানো যায়। প্রত্যন্ত এলাকায় এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
মনোক্যাবের মার্কেটিং ম্যানেজার টর্স্টেন ফ্যোর্স্টার্লিং বলছেন, “আমরা এমন একটি যান তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেটি আকার এবং স্বতন্ত্রতা বিবেচনায় আপনার ব্যক্তিগত গাড়ির মতোই হবে। একক-ট্র্যাক রুটের সমস্যা হলো—আপনি শুধু এক দিকে যেতে পারেন। সেখানে দ্বিমুখী ট্র্যাফিক সম্ভব নয়।”
বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলে মনোক্যাব বানিয়েছে। আগ্রহীদের জন্য তারা নিয়মিতভাবে দর্শনার্থী দিবসের আয়োজন করে। এতে অংশ নিতে সারা বিশ্ব থেকে মানুষ জার্মানিতে আসে।
নতুন এই পরিবহণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে মানুষ কতটা আগ্রহী হবে? মানুষের ইচ্ছা সম্পর্কে আরও জানতে নির্মাতারা একটি অভিনব মডেল তৈরি করেছিলেন। যাত্রীরা কি আসলে মনোক্যাব ব্যবহার করবেন?
জার্মানির বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ানা দ্রাইশাল্যুক বলেন, “মনোক্যাবে বসার জায়গাটি বর্তমানে ব্যবহৃত গণপরিবহণের চেয়ে ছোট ও সংকীর্ণ। তাই নিরাপত্তা নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে যাত্রীরা যখন একে অপরকে চেনেন না, তখন এটি নিয়ে ভাবনার বিষয় আছে। কারণ, মনোক্যাব প্রত্যন্ত এলাকায় চলার কথা, এবং সেই সুযোগ নিয়ে কোন যাত্রী কীরকম আচরণ করবেন, তা নিয়ে মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত।”
এই ধরনের যাত্রীদের কারণে কি মনোক্যাব উলটে যেতে পারে? এই বাহন আসলে কতটা নিরাপদ? একটি জাইরোস্কোপ দিয়ে গাড়িটি সোজা রাখা হয়, আর নিচে থাকা ওজন কেবিনকে স্থিতিশীল রাখে।
বিষয়টি খেলনার মতো—ক্রমাগত ঘুরতে থাকায় এটি উল্লম্ব অবস্থান ধরে রাখে। থামানো হলে পড়ে যেতে পারে।
মনোক্যাবের প্রকল্প প্রধান টোমাস শুল্টে জানান, “সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মনোক্যাবটি ডিজাইন করা হয়েছে। যেমন—হয়তো অনেক বেশি ওজনের এক যাত্রী একপাশে বসতে পারেন, কিংবা ক্রসউইন্ডের গতি ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার হতে পারে। সে কারণে কেবিনের ভেতর অনেক দোলাদুলি করলেও এটি উলটে যাবে না। ফুটবল সমর্থকেরা পার্টি করলেও তাদের পক্ষে ১.২ মিটার প্রস্থের মধ্যে এমন গতিশীল শক্তি তৈরি করা সম্ভব নয়, যার কারণে এটি উলটে যেতে পারে।”
কিন্তু মনোক্যাব পরিচালনা কি আর্থিকভাবে সফল হতে পারে? বিশেষ করে যদি নিরাপত্তার কথা ভেবে একজন যাত্রীর জন্য পুরো কেবিন বুক করতে হয়? কারণ, ধারণা করা হচ্ছে—ভবিষ্যতে একেকটি কেবিনের দাম একটি বিলাসবহুল গাড়ির সমান হতে পারে।
ফ্যোর্স্টার্লিং বলেন, “এটি খুব বেশি ব্যয়বহুল হলে চলবে না। পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণও সাশ্রয়ী হতে হবে। আমাদের এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেবিন ডিজাইন করা দলও এসব নিয়ে ভাবছে—কেবিনের ওজন বেশি না করা, দ্রুত উৎপাদন, ভালোভাবে পরিচালনা ও পরিষ্কার করা যায় এমন যান তৈরি। এই সব কিছুর সমাধান এখনই খুঁজে বের করতে হবে।”
বর্তমানে শুধুমাত্র একটি প্রোটোটাইপ আছে এবং এটি নিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করা হচ্ছে। বেশি সংখ্যায় উৎপাদনের জন্য নির্মাতারা বিনিয়োগকারী খুঁজছেন। জার্মানরা এর সফলতা নিয়ে খুব আশাবাদী। যদিও ১৯০৭ সালে আবিষ্কারের পর থেকে মনোরেল এখনও কোনো বড় সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
“যে ধারণাগুলো বিদ্যমান রাস্তা বা রেল নেটওয়ার্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না, সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমরা বিদ্যমান রেলপথের কথা ভাবছি। তাই ম্যাগলেভ ট্রেন কিংবা অন্যান্য মনোরেলের মতো আমাদের নতুন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে না,” বলে জানান ফ্যোর্স্টার্লিং।
এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি সরকারের কাছ থেকে ২৯ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা পেয়েছে। তাই ২০৩২ সালের মধ্যে বেশি সংখ্যায় মনোক্যাব উৎপাদন শুরু হতে পারে। তার আগে নির্মাতারা এর এক বড় সমস্যা সমাধানের আশা করছেন—“লাইন পরিবর্তন করা এখনও সম্ভব নয়,” জানান ফ্যোর্স্টার্লিং।
তবে একটি বিষয় নিশ্চিত: আর্থিকভাবে সফল হতে হলে জার্মানির অন্যান্য গণপরিবহনের মতো, মনোক্যাবেরও সরকারি ভর্তুকির প্রয়োজন হবে।