থিয়েটারে এসেছি মানুষের চেতনাকে জাগাতে : মোমেনা চৌধুরী

বর্তমান সময়ের আলোচিত মঞ্চনাটক ‘লালজমিন’। নাটকটিতে একক অভিনয়ের কারণে আলোচনার তুঙ্গে অভিনেত্রী ও শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারে প্রধান নির্বাহী মোমেনা চৌধুরী। মঞ্চে যিনি তাঁর শিল্পধারায় নিজেকে সম্পূর্ণ দক্ষ হিসেবে প্রমাণ করতে পারেন, পরিচয় দেন এক জাতশিল্পীর। দাপুটে এই অভিনেত্রী নিয়মিতভাবে কাজ করেছেন টিভি নাটক ও সিনেমাতেও। বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন। লালজমিন নাটকটিতে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এ নারীর সংগ্রামী জীবনের নাট্যপ্রকাশ। পরিবেশনা করেছে ‘শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটার’। মান্নান হীরার রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। গত ২০ জুলাই ফেনীতে দুদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকটি ১৬০তম মঞ্চায়ন হয়। তাৎক্ষণিক প্রশংসা করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ, ফেনী জেলা প্রশাসক মনোজ কুমার রায়, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক নাট্যব্যক্তিত্ব রোকেয়া প্রাচী। থিয়েটারের বিভিন্ন বিষয় এবং লালজমিন নিয়ে ফেনী সার্কিট হাউসে কথা হয় মোমেনা চৌধুরীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
প্রশ্ন : এ পর্যন্ত ১৬০টি শো হয়েছে ‘লালজমিন’ নাটকটির, এর পরে কোথায় শো হচ্ছে?
মোমেনা চৌধুরী : ২০ জুলাই ফেনীতে ১৬০তম শো হয়েছে, ২১ জুলাই কুমিল্লা টাউনহলে ১৬১তম, ২৬ জুলাই ঢাকা টিএসসি ১৬২তম, ২৮ জুলাই পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমিতে ১৬৩তম, ২৯ জুলাই পঞ্চগড় মহিলা কলেজে ১৬৪তম, ৩০ জুলাই ঠাকুরগাঁও শিল্পকলা ১৬৫তম, ৩১ জুলাই দিনাজপুর শিল্পকলায় ১৬৬তম শো হবে।
প্রশ্ন : নাটকটি দেখে অনেকে আপনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে, অনুভূতি কেমন?
মোমেনা চৌধুরী : আসলে নাটকটিতে আমি একাই অভিনয় করছি, তার জন্য যে ধরনের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। লালজমিন আমার দেশের কথা, আমার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির কথা, আমাদের ইতিহাসের স্মরণীয় যে কথাগুলো আমরা ভুলে যাচ্ছি, সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নাটকটি দেখে অনেকে তরুণ আমাকে বলেছে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু নাটকটির মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি। যেমন ভারতে অনেক দর্শক আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছে, একজন দর্শক এমনও বলেছে, তোমাকে ছুঁলে বাংলাদেশকে ছোঁয়া হবে (আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন কথাটি বলার সময়)। এটির অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। নাটকটির অনুভূতি এতই তীব্র যে আমরা অর্থের কথা না ভেবে সামান্য অনুদানে তথা পথ খরচা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছি। লালজমিনকে আমি আমার সন্তান হিসেবে মনে করি, আমার যে দুই সন্তান রয়েছে, তাদের মতো লালজমিনও আমার একটি সন্তান। এটিকে আমি নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করি।
প্রশ্ন : লালজমিন নাটক সম্পর্কে দর্শকদের কিছু বলুন?
মোমেনা চৌধুরী : বর্তমানে দেশে-বিদেশে ১৬০টি বেশি জায়গায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। আমি দেখেছি দর্শকদের ভালোবাসা, অনুভূতিগুলো। যা থেকে আমরা প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি। আমরা নাটকটি নিয়ে পৃথিবীর যে প্রান্তে গিয়েছি, তারাই অভিভূত হয়েছে। এত মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি আমাদের পুরো টিমকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। নাটকটির মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে এ দেশটা পাওয়ার পেছনে অনেক মানুষের ত্যাগ, তিতিক্ষা, বহু মা-বোনের সম্মানহানি, শহীদদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই সুন্দর দেশটি পেয়েছি। বাংলাদেশ প্রত্যয়টি পেয়েছি। এটি আমার দেশ, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। বাংলাদেশ প্রত্যয় নিয়ে আমি পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছি। গৌরবময় ইতিহাসের কথাই বলতে চেয়েছি। যে ইতিহাসকে ধারণ করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : থিয়েটার আন্দোলন কী?
মোমেনা চৌধুরী : থিয়েটার একটি সম্মিলিত আন্দোলন। সকলে মিলে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার সারা দেশে থিয়েটার কমপ্লেক্স করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেখানে নাটকের কর্মী ও শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। থিয়েটারকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দেওয়াই এর লক্ষ্য। এটি নির্ভর করবে দেশের কিছু নবীন, উৎসাহী এবং প্রধানত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিতে তুলে ধরার যে আন্দোলন, সেটাই থিয়েটার আন্দোলন।
প্রশ্ন : থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী?
মোমেনা চৌধুরী : থিয়েটার তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। ভবিষ্যৎ খুবই ভালো। থিয়েটার সারা পৃথিবীতে একটি ক্লাসিক আর্ট। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা হচ্ছে বাংলাদেশে থিয়েটারকে ক্লাসিক আর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল টিকেট হচ্ছে থিয়েটারের টিকেট। থিয়েটার দেখতে হলে দুই মাস আগে টিকেট কাটতে হয়। সে জায়গায় আমরা যেতে পারিনি। আর এখন তো প্রযুক্তির উর্বরতার কারণে মুক্ত আকাশে হারিয়ে যাচ্ছি প্রতিমুহূর্তে রিমোটের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া বিশেষ করে ঢাকার কথাই যদি বলি, তাহলে এত জ্যাম ঠেলে থিয়েটার দেখতে আসাটা অনেক কষ্টসাধ্য। কিন্তু তারপরও শিল্পকলায় প্রতিদিন তিন/চারটি করে নাটকের শো হচ্ছে। নিশ্চয় দর্শক রয়েছে বলেই এখনো প্রতিদিন শো হচ্ছে। সে হিসেবে বলা যায়, থিয়েটার তার আপন গতিতেই চলছে। নদী যেমন তার গতিতে চলছে, থিয়েটারও সে গতিতে চলছে।
প্রশ্ন : টিভি নাটকের যে জনপ্রিয়তা রয়েছে, সে হিসেবে থিয়েটারের প্রতি মানুষের এত আকর্ষণ নেই কেন?
মোমেনা চৌধুরী : আসলে আমাদের চেতনার জায়গাটাকে উন্নত করতে হবে। চেতনার জায়গাটা উন্নত হলেই আমাদের থিয়েটারের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। থিয়েটার কী, থিয়েটার সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা, বিতর্ক বিশেষ করে তরুণদের মাঝে তুলে ধরতে হবে। এভাবে তুলে ধরতে পারলে আমাদের দেশেও থিয়েটার একটি ক্লাসিক আর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রশ্ন : নাট্যকাররা তাঁদের নাটকের মাধ্যমে সমাজকে কী বার্তা দিতে চান?
মোমেনা চৌধুরী : সমাজের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, অপরাধ অর্থাৎ সমাজে যে সকল অসংগতি রয়েছে তার বিরুদ্ধে থিয়েটার বা থিয়েটারকর্মীরা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বার্তা দিয়ে থাকেন। বর্তমান সময়ে ঘটনা, অসংগতির কথা নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেন, ভবিষ্যৎকে বলতে চান, ইতিহাস বলতে চান। মানুষকে পরিবর্তনের বার্তা দিতে চান। এই যে মুক্তিযুদ্ধের নাটক দিয়ে সারা দেশে ছুটে যাচ্ছি, এটি আসলে মানুষের চেতনার জায়গাকে ডেভেলপ করার জন্য। নাটকটির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রত্যয় নিয়ে আমরা সারা দেশের মানুষের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছি। এটি আমাদের একটি মেসেজ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে। প্রতিটি দেশের নাট্য আন্দোলনে নাট্যকর্মীরা সেই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সামাজিক সংহতি, অসংগতি ইত্যাদি শ্রম, ঘাম, মেধা দিয়ে নাটকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন।
প্রশ্ন : থিয়েটার সমাজের কী প্রয়োজনে আসে?
মোমেনা চৌধুরী : থিয়েটার হচ্ছে এমন একটি জিনিস, যা জীবনের কথা বলে, একটি বদ্ধ ঘরের মধ্যে থিয়েটার করে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, পরিবর্তনের জন্য সারা দেশে ছড়িয়ে যেতে হবে মানুষের দ্বারে দ্বারে। তাহলে হয়তো মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করা যাবে। যেমন পথনাটক, সমাজ যখন অসুস্থ ও অস্থির হয়ে ওঠে, পথনাটক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়। চেতনাকে শাণিত করা হয়। সে হিসেবে আমি মনে করি, থিয়েটারের মাধ্যমে নাট্যকর্মীরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে হবে। এটাই সমাজে থিয়েটারের প্রয়োজনীয়তা।
প্রশ্ন : থিয়েটারে প্রায় তিন দশক, দীর্ঘ সময়ে অনেকে থিয়েটার থেকে ঝরে পড়েছেন, আপনি এখনো রয়ে গেছেন, এ বিষয়ে একটু বলেন?
মোমেনা চৌধুরী : এটা আসলে আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাগল বলা যেতে পারে। আমার সঙ্গে থিয়েটারে অনেক এসেছেন, সবাই হয়তো এখনো থাকতে পারেনি। অনেকে আছেন। থিয়েটার প্রচুর পরিমাণে ধৈর্য এবং মনোযোগ লাগে। শ্রম, ঘাম লাগে। আমি এত দিন পর্যন্ত টিকে আছি, এটি আসলে অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। আমি শৈশব থেকে না বুঝেই মানুষের জন্য কিছু কাজ করতে চেয়েছি। বগুড়ায় বিভিন্ন কালচারাল অ্যাক্টিভিটিস করেছি, থিয়েটার করেছি। পলিটিকস করেছি, বগুড়া ইয়ুথ ক্লাবে বিভিন্ন সামাজিক কাজ করেছি। সেখান থেকে থিয়েটারে এসেছি মানুষের মাঝে কিছু মেসেজ দেওয়ার জন্য। থিয়েটারে এসেছি মানুষের চেতনাকে জাগাতে।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক সময়ে আপনি আর কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
মোমেনা চৌধুরী : আমি মূলত ‘আরণ্য’কে কাজ শুরু করি প্রায় ২৮ বছর আগে, আর ২০১১ থেকে শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারে কাজ করছি। একটি নাটকই আমাদের হয়েছে ‘লালজমিন’। ‘লালজমিন’ নাটক নিয়ে আসলে খুব বেশি ব্যস্ত। এটির প্রতি মানুষের এত বেশি আবেদন যে সারা দেশে এটি নিয়ে যেতে হচ্ছে। যার কারণে আমার দল ‘শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটার’ অন্য কোনো প্রোডাকশনের চিন্তা করতে পারিনি। তবে আমাদের দলে এখন নতুন, পরিশ্রমী কিছু তরুণ নাট্যকর্মী তানভীর সানী, জুয়েল, মামুন বিশ্বাস, সাজিদ, বাশার, মাহবুব, সাইফসহ অনেক সম্ভাবনাময় কিছু তরুণ যোগ দিয়েছে। আশা করছি, নতুন একটি প্রোডাকশনে হাত দিতে পারব শিগগিরই।