নতুন প্রজন্মের ওপরই থিয়েটারের ভবিষ্যৎ : শুভাশিষ ভৌমিক

ঢাকা থিয়েটারের নাটক্যকর্মী শুভাশিষ ভৌমিক। ১৯৭৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে থিয়েটার ও মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত। অদ্যাবধি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন থিয়েটার ও মঞ্চ নাটকের সঙ্গে। ঢাকা থিয়েটারে অধীনে অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘হাত হদাই’, ‘ধূর্ত ওই’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘আওয়ার কান্ট্রিজ গুড’ প্রভৃতি।
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘বিবাহ’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন সুভাশিষ ভৌমিক। পরে বহু ধারাবাহিক ও একক নাটকে অভিনয় করেছেন। হানিফ সংকেতের উপস্থাপনা ও পরিচালনায় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত শিল্পী সুভাশিষ ভৌমিক। বড় পর্দায় অভিনয় করারও সুযোগ হয়েছে তাঁর। ‘সবুজ সংকেত’, ‘জনম দুঃখী’, ‘গেরিলা’, ‘রান’, ‘ভুবন মাঝি’ তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। সম্প্রতি এ নাট্যশিল্পী ফেনীতে একটি অনুষ্ঠানে এলে কথা হয় থিয়েটারের বিভিন্ন বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
প্রশ্ন : কীভাবে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হলেন?
শুভাশিষ : ১৯৭৮ সালে যখন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, যদিও ক্লাস শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। ভর্তির কিছুদিন পর ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, নির্বাচনে অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি ডাকসুর নাট্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর মধ্যে প্রয়াত সেলিম আল দীনের ছোট ভাই ছিল আমার ক্লাসমেট ও খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তার সঙ্গে এত বেশি বন্ধুত্ব অথচ জানতামই না নাট্যকার ড. সেলিম আল দীন তাঁর আপন বড় ভাই। এর মধ্যে ফরীদি ভাই একদিন বললেন, আমরা ৪৫ দিনব্যাপী নাটকের ওয়ার্কশপ করছি জাহাঙ্গীরনগরে, তুই চাইলে আয়। লাগাতার কাজ করে আমরা একটি নাটক প্রোডাকশন করলাম ‘সংবাদ কার্টুন’ নামে। তো আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাট্যচর্চা শেখার পর থেকে এটাই আমার প্রথম নাটক বলা চলে। যদিও তা কোথাও মঞ্চস্থ হয়নি। তারপরে ১৯৮০/৮১-এর দিকে জাহাঙ্গীরনগরে ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করলাম। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাট্যকার কায়জার আহমেদ, আমার বন্ধু ফারুক আহমেদ, আমি, শহীদুজ্জামান সেলিম, ইমাম হাসানসহ আরো অনেকে। ওই সংগঠন থেকেই সেলিম আল দীনের ‘শকুন্তলা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করি সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে। এটাই আমাদের প্রথম অভিনয় বলা যায় দর্শকদের সামনে। এভাবেই আমার থিয়েটার জীবনের সূত্রপাত। এরপর জড়িয়ে পড়ি বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে নাটক করা, সংগঠন করা এবং নাটক তৈরি করা। তারপর ১৯৮৩ সালে আমি ঢাকা থিয়েটারে আসি। তার পর থেকে অদ্যাবধি এখনো চলছেই।
প্রশ্ন : থিয়েটার আন্দোলনটা কী?
শুভাশিষ : স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের কিছু নবীন, উৎসাহী এবং প্রধানত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু করে। ধরে নেওয়া যায় স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুবসমাজের নানা অবক্ষয়ের মাঝে এটা ছিল একটা আশার আলো। সে সময় তাদের ধারণা অনুযায়ী থিয়েটার চর্চা সমাজের নানাবিধ পরিবর্তন আনতে পারে। সমাজ পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়াকে তারা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বলে অভিহিত করে।
প্রশ্ন : নাট্যকাররা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চান?
শুভাশিষ : আসলে শুধু অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নাটক হয়স না, সেখানে সংলাপ থাকে, কাহিনী থাকে, মেসেজ কিংবা মূল থিম থাকে। থাকে আরো অনেক কিছু। যেমন সেলিম আল দীনের নাটকে অঙ্গভঙ্গি ছিল না তেমন। তার একটি নাম ছিল ‘হাত হদাই’। এই নাটকের একটি চরিত্র এমন—একজন গ্রামীণ অশিক্ষিত লোক, যে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু সে পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুরে তাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবন বৈচিত্র্য সব আত্মস্ত করে ফেলে। তার ভ্রমণ থেকে বাচাই করা সাতটি ভ্রমণ কাহিনীর অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘হাত হদাই’ (হাত মানে সাত, হদাই মানে সদাই) নাটকটি। নাট্যকার এর মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি বোঝাতে চাইলেন যে, একজন মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না জানলেও ভ্রমণের মাধ্যমে কীভাবে সে পৃথিবীর ইতিহাস, জীবন বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। এই যে মানুষের শিক্ষা, জীবন সম্পর্কে তার বোধ এই বিষয়টিতে তুলে আনা হয়েছে। এখানো আরো একটি বিষয় হচ্ছে, এই লোকটা সব সময় মৃত্যুকে ভয় করত। কিন্তু সব সময় আনন্দ ফুর্তির মধ্যে থাকত। নদীর চড়ে টং বানাইয়া থাকত। তার সাত ছেলে। সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলেও সে তার স্ত্রীকে নিয়ে টংয়ের ঘরে থাকত। সারাক্ষণ আনন্দের মধ্যে থেকে সে বোঝাতে চাইত আনন্দের মধ্যে থাকাই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর। এই যে তার জীবনবোধ, প্রজ্ঞা এটা কিন্তু অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যে নেই। মূল বিষয় হলো প্রতিটি নাটকের মধ্যে একটি মূল থিম থাকে, সেটিই পরিচালক বা নাট্যকারে মেসেজ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন : থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী?
শুভাশিষ : গোটা বিশ্বে থিয়েটার চর্চা ঊনবিংশ শতাব্দীর মতই বিংশ শতাব্দীতে চর্চা, অভিনয়, নিরীক্ষা এবং দর্শক নন্দিত হিসেবেই রয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক থিয়েটার চর্চা তথা গ্রুপ থিয়েটার চর্চা হওয়াতে দেশের অধিকাংশ মানুষ থিয়েটারে নতুন কিছু দেখার অপেক্ষায় থাকত। পরিবর্তিত নাগরিক জীবন থিয়েটার চর্চার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যেসব মানুষের হাত ধরে অনেকেই থিয়েটার চর্চায় এগিয়ে এসেছিলেন তাদের অনেকেই প্রবীণ হয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের হাতেই থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী এবং সেটা নির্ভর করে নতুন প্রজন্মের ওপর।
প্রশ্ন : থিয়েটারে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শুভাশিষ : বর্তমানে মঞ্চ নাটক কমে গেছে। মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, কোনো নতুন নাটক আসছে না। আগেকার যে ভালো নাটকগুলো মঞ্চায়িত হচ্ছে না। ফলে টিভি নাটকের দিকে প্রজন্ম বেশি ঝুঁকছে। মঞ্চ নাটকেরও এখনো প্রচুর দর্শক আছে, এটি অস্বীকার করা যাবে না। এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের নাট্যকর্মীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নন্দিত এবং জনপ্রিয় মঞ্চে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমানে নাট্যকর্মীদের এ বিষয়ে কাজ করা অপরিহার্য।
প্রশ্ন : আপনার দৃষ্টিতে নাট্যকার সেলিম আল দীন?
শুভাশিষ : তাঁর কথা বলতে গেলে কী বলব, কেউ যদি বলে রবীন্দ্রনাথ কত বড় লেখক ছিলেন? প্রশ্নটা এমনই হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যে নাট্যকার হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি শুধু নাট্যকারই নন, গান লিখতেন, প্রবন্ধ লিখতেন। সাধারণ মানুষের কথা লিখতেন। তাঁর সঙ্গে মেলা সময় সময় ধরে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এ থেকে মনে হয়েছে, এমন মানুষ পাওয়াটা আসলেই দুষ্কর। পৃথিবীতে খুব কমই এমন মানুষ আসে। এক কথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যকার।
প্রশ্ন : টিভি নাটকের যে জনপ্রিয়তা, সে হিসেবে থিয়েটারের প্রতি মানুষের এত আকর্ষণ নেই কেন?
শুভাশিষ : দেখুন, এর উত্তরটা খুবই সহজ, একটা শিশুর কাছে আইসক্রিমের যে মূল্য তার কাছে কিন্তু করলার মূল্য নাই। ফলে আমাদের মন মানসিকতায় এমন উচ্চতায় গড়ে ওঠেনি যে, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা পার্থক্য করবে। এ কারণে আমাদের কাছে স্টার জলসা আর জি-সিনেমাই ভালো লাগে। আমরা বুঝছি না কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, কিন্তু মঞ্চ নাটকেরও দর্শক যে আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রচুর নাট্যকর্মী এখনো নাটক করছে। নাটককে ভালোবাসছে। মঞ্চ নাটক দেখার বিষয়। দেখতে দেখতেই অভ্যস্ত হবে।
প্রশ্ন : ইত্যাদিতে অভিনয় করে আপনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সেখানে কমেডি চরিত্রেই আপনাকে বেশি দেখা যায়। বাইরে প্রতিক্রিয়া কেমন পান?
শুভাশিষ : আমাকে মানুষ কীভাবে চেনে, ব্যক্তিগতভাবে আমি কেমন, দুটো বিষয়। যেমন হুমায়ূন ফরীদি বেশিরভাগ সময় খারাপ চরিত্রে অভিনয় করলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি তেমন নন। তো ইত্যাদিতে আমি যেটা করি, সেটা তো অভিনয়। তা ছাড়া পত্রিকায় দেখলাম আমাদের দেশে একচল্লিশটি টেলিভিশন চ্যানেল, মানুষ কিন্তু ঠিকমতো কুড়িটার নামও বলতে পারবে না। তাহলে এতগুলো চ্যানেলের কাজ কী? এরা আমাদের শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি খেলাধুলা ঠিকমতো তুলে ধরছে কি না। যদি তুলে ধরতে না পারে, তাহলে এতগুলো প্রচারমাধ্যম থাকার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না। তিন মাসে দুই থেকে তিন মিনিট অভিনয় করি। এ ছাড়া সমাজের যে বাজে বিষয়গুলো রয়েছে, অভিনয়ের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি। বাজে জিনিসগুলোর প্রতিবাদ জানিয়ে আমি অভিনয় করি। এবারের ইত্যাদিতেও সে রকম একটি অভিনয়ই করেছি। এই যে আমাদের দেশে কত বড় বড় হাসপাতাল রয়েছে, তাদের আচরণ এমন যে—লাশ নিয়ে যান, টাকা দিয়ে যান। এটা তো কোনো মানবিকতা হতে পারে না। তাহলে তো হাসপাতালের কোনো প্রয়োজন নেই। এভাবে আমি সমাজের বাজে বিষয়গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : ধন্যবাদ আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য।
শুভাশিষ : আপনাকেও ধন্যবাদ।