রোগ বাতিক কী, কেন হয়?

লিমার (ছদ্মনাম) বয়স ৩৫ বছর। তিনি এক সন্তানের মা। দীর্ঘদিন থেকে তাঁর বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা যায়। চিকিৎসকের কাছে গেলে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কোনো শারীরিক কারণ খুঁজে পান না। দেশ-বিদেশের বহু চিকিৎসক দেখিয়েছেন, তবে চিকিৎসকরা কোনো রোগ ধরতে পারেননি। একটি রোগের উপসর্গ কিছুটা কমলে আরেকটা রোগের উপসর্গ দেখা যায়। প্রথমে তাঁর পেট জ্বলত। লিমার ধারণা ছিল, পেটে কোনো ক্যানসার বা পরিপাকতন্ত্রে গুরুতর রোগ হয়েছে। কয়েক মাস পর তাঁর টনসিল আক্রান্ত হয়েছে বলে চিকিৎসকের কাছে বলতেন। চিকিৎসক একরকম বাধ্য হয়েই তাঁর টনসিল অপারেশন করে দেন। এর পর তাঁর কাছে মনে হতো, এইড্স হয়েছে। অনিরাপদ যৌনসঙ্গম করেননি তিনি, রক্তও নিতে হয়নি কখনো, তাহলে অস্ত্রোপচার করার সময় জীবাণু ঢুকে থাকতে পারে বলে তাঁর ধারণা হয়। বেশ কয়েকবার এইচআইভি পরীক্ষা করার পর মনে হয়, পরীক্ষাগুলো ঠিকমতো করা হয়নি বা জীবাণু হয়তো সুপ্ত অবস্থায় আছে, তাই ধরা পড়েনি। ফলে আবার করতে হবে। যদিও খুব ঘন ঘন চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, তবে চিকিৎসকের প্রতি লিমার আস্থা আগে থেকেই কম। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়, কয়েকজন চিকিৎসক দেখালেন। শেষমেশ চিকিৎসক সাহেব তাঁকে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে পাঠালেন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সবকিছু শুনে তাঁকে জানালেন, এটি একটি মানসিক সমস্যা, এর নাম হাইপোকন্ড্রিয়াসিস। বাংলায় এটিকে রোগ বাতিক বলা যায়।
হাইপোকন্ড্রিয়াসিস কী
হাইপোকন্ড্রিয়াসিস একটি সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার। এটিতে মানসিক সমস্যার জন্য শারীরিক উপসর্গ দেখা যায়। হাইপোকন্ড্রিয়াসিসের প্রধান লক্ষণ হলো ব্যক্তি মনে করে, তাঁর কোনো গুরুতর রোগ হয়েছে বা শিগগিরই কোনো গুরুতর রোগ হবে। রোগটি হয়েছে বা হবে বলে তিনি এতটাই বিশ্বাস ও চিন্তা করেন যে, তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়। সারা দিন রোগটি নিয়ে ভাবতে থাকেন এবং রোগটি আছে কি না, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন। শরীরে কোনো সমস্যা নেই এমনটি বিভিন্ন চিকিৎসক জানালেও তা বিশ্বাস করতে চান না; বরং ভাবেন, চিকিৎসক রোগ ধরতে পারছেন না। এই ভুল বিশ্বাসগুলো শরীরের বিভিন্ন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে অপব্যাখ্যা করে। ফলে সেগুলো কঠিন রোগের উপসর্গ বলে রোগীর কাছে মনে হয়। যদিও বা একটি রোগের দুশ্চিন্তা দূর হয় তো আরেকটি রোগের দুশ্চিন্তা মনের মধ্যে চলে আসে। তাই ব্যক্তি এক চিকিৎসক থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে ছুটতে থাকেন। মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্টগুলোর প্রতিও আস্থা রাখতে পারেন না। দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তি মানসিকভাবে কষ্ট পেতে থাকেন।
কেন হয়
ছোটবেলায় অভিভাবকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে অতি সতর্কবার্তা পাই। পরিবারের কারো হাইপোকন্ড্রিয়াসিস থাকলে বা কেউ সারা বছর ধরে অসুস্থ থাকলে, স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা, সমসাময়িক কারো মৃত্যু, নিজের মৃত্যুর পর পরিবারের কী হবে, এমন দুশ্চিন্তার ফলে এ রোগের সূত্রপাত হতে পারে।
চিকিৎসা
হাইপোকন্ড্রিয়াসিসেরও চিকিৎসা মূলত দুই ধরনের, যথা : ওষুধের মাধ্যমে ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে। সাইকিয়াট্রিস্ট এসএসআরআইয়ের মতো ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করেন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা ক্লায়েন্ট বা রোগীর সার্বিক অ্যাসেসমেন্ট করেন, যেসব কারণে তাঁর রোগটি ভালো হচ্ছে না তা চিহ্নিত করেন এবং তাঁর চিন্তা ও প্রত্যক্ষণের ভুলগুলো পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসা করলে রোগটি অনেকাংশেই ভালো হয়।
তানজির আহম্মদ তুষার : সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।