আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

অনেকেই ব্যর্থতা বা হতাশা থেকে নিজের জীবনকে নাশ করার মতো বা আত্মহত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় কী? এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮৩০তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক তাজুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : আত্মহত্যার মতো একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কী করে মানুষ নিয়ে ফেলতে পারেন। কী করে সম্ভব এটা?
উত্তর : ভালো কথা বলেছেন। মানুষ বিভিন্নভাবেই মারা যায়। রোগ-শোকে মারা যায়। এমনকি আমরা হত্যা করি। তবে কখনো কখনো মানুষ নিজেই নিজেকে হত্যা করে। বেদনাদায়ক বিষয় হলেও এটি চলে আসছে। ওয়ার্ল্ড হেলথের গবেষণা অনুযায়ী, মৃত্যুর ষষ্ঠ তালিকায় কিন্তু রয়েছে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা মানুষ কখন করে? ভালো কথা বলেছেন। আসলে দেখুন, মানুষ বাঁচার জন্য কত চেষ্টা করে। একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচতে চায়। ক্যানসারে মরে যাবে যাবে, তারপরও বাঁচতে চায়। আপনাকে নিয়ে আটকে রাখলেও তারপরও বলবে, জীবনটা বাঁচিয়ে রেখো কোনোরকমে। আহত হয়ে থাকলেও মানুষ বাঁচতে চায়। কোন পর্যায়ে গেলে মানুষ মরতে চায়? মনস্তত্ত্বের জায়গা থেকে দুটো জিনিস ভাবতে হবে। একটি হলো আত্মহত্যা করা হয় ইমপালসিভ পদ্ধতিতে। তাৎক্ষণিক আবেগতাড়িত হয়ে মস্তিষ্কের কার্যকলাপগুলো সাময়িকভাবে বিবেচনা বন্ধ হয়ে যায়; আক্ষেপ, ক্ষোভ, রাগটাই তখন বড় হয়ে থাকে।
আরেকটি হলো পরিকল্পনা করে, প্রোগ্রাম করে, আস্তে আস্তে পদ্ধতি ঠিক করে, এরপর আত্মহত্যা করে। আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহত্যা করে সাধারণত তরুণরা বা কৈশোর বয়সীরা। আরেকটু বলে রাখা ভালো, আত্মহত্যা বেশি হয় বয়ঃসন্ধি দলে, আরেকটি হলো বৃদ্ধ বয়সে। বয়ঃসন্ধিরা সাধারণত আবেগতাড়িত হয়ে কাজটি করে। যেমন : ইদানীং দেখা যাচ্ছে, হয়তো পরীক্ষায় ফেল করেছে। এই জন্য আত্মহত্যা করছে। নিজের আক্ষেপ থেকেও হতে পারে, পরিবার বা বন্ধুবান্ধব অন্যান্য জায়গা থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে করতে পারে।
প্রশ্ন : এবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ বিষয়ে আপনার একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখাও পড়েছি। আপনি এটি নিয়ে ভেবেছেন যেহেতু, সে জন্য যদি একটু বলেন, পরীক্ষায় ফেল করে একটি সন্তান তাদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে ফেলছে—এই পর্যায় একজন সন্তান যাচ্ছে কেন?
উত্তর : কুমিল্লায় যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, সে ফেল করার পরে তার মা-বাবা তার প্রতি সাপোর্টিভ ছিল। বলেছিল, তুমি তো আর বেশি বড় হয়ে যাওনি, এখনো সময় রয়েছে, পারবা। এবং সে নিজেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আগামীবার আবার পরীক্ষা ঠিকমতো দেবে।
তবে এরপরও ঘটনাটা লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন, কেন আমরা আত্মহত্যা করি? ওরা কেন এই পর্যায়ে চলে যেতে পারে? সেটা হচ্ছে, এর পর থেকে অন্য যারা পাস করেছে, তারা বাসায় এসে মিষ্টি বিতরণ করছে। তার বাবাকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন বলছে, ‘তোমার ছেলে ফেল করেছে, তোমার বউ ছেলেকে বেশি প্রশ্রয় দিয়েছে।’ সামাজিক তুলনা করা হয়েছে। বাবা ভাবলেন, অন্য ছেলেরা ভালো করেছে, আমার ছেলে ফেল করল। আমার বউ বোধ হয় দায়ী রয়েছে। তখন সে তার স্ত্রীকেও মারতে গেল। তবে বাবা কিন্তু প্রথমে সাপোর্টিভ ছিল।
এ রকম পর্যায়ে ছেলেটির নিজেকে খুব হেয় অপদস্থ, অপমানিত মনে হয়। তার ওপরে আবার দেখল বাবা-মাকে মারতে গেল, তখন কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিল আমি মারা যাব। মারা যাওয়ার আগে এটি লিখে গেল।
আপনি যেটি বললেন, পরীক্ষা তো খুবই ক্ষুদ্র জিনিস, এটা তো জীবন-মরণের বিষয় নয়। আসলে তাদের জন্য আমরা সেটা করে ফেলছি। আমরা এমন একটি মানসিক আবহ তার ভেতর তৈরি করে দিচ্ছি, যে পরীক্ষাটা পাস করাটা জীবন-মরণ বিষয়। এটা পাস করা বা জিপিএ ফাইভ পাওয়া—এটা যদি করতে পারো, তাহলে তুমি জীবনে টিকে গেলে, না হলে হেরে গেলে। সফলতার দ্বারে যখন আসবে তখন সম্মান, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সবই পাবে। তোমার একটি মর্যাদা থাকবে, অবস্থান থাকবে। এটা না করা মানে তুমি কিছু করতে পারলা না, তোমার সবকিছু শেষ। তোমার ভবিষ্যৎও নেই। কিছুই নেই। জীবন-মরণের মতো তাদের অবস্থাটা আমরা নিয়ে নিই। প্রত্যাশাটা আমরা এমনভাবে ছেলেমেয়েদের ওপর আরোপিত করে দিই যে তোমাকে যেভাবেই হোক, ভালো করতে হবে। অন্তত পাস করতে হবে। তবে এটি জীবন-মরণের প্রশ্ন হওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন : একজন মানুষ পরীক্ষায় ভালো করলেই যে ভালো করবে, এ রকম নিশ্চয়তা নেই। অনেকে পরীক্ষা খারাপ করে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও অনেকে অনেক বড় কিছু হয়েছে। সারা পৃথিবীতে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং পরীক্ষায় ভালো করতে হবে, এদিকে ঢেলে দিয়ে আমাদের সন্তানদের যে আমরা বিপদগ্রস্ত করছি—এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : আসলে জীবন তো একটি জার্নি (ভ্রমণ)। এটি হলো আমি একটি জায়গায় পৌঁছাব, ওপরে উঠব। হ্যাঁ, আমরা অনেক পথে সেটি করতে পারি। পৃথিবীর সব মানুষেরই কি ভালো ভালো লেখা পড়া করে ওপরে উঠে বা সফলতা হয়?
আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কথা বলেন, বিল গেটস, চার্চিল এমনকি আইনস্টাইন পর্যন্ত তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে দেখবেন, তাঁরা কি এত ভালো চৌকস ফল করেছে। খেলাধুলায় যারা ভালো করছে বা সংগীতে যারা ভালো করছে, তাদের ফল কি খুব ভালো? অর্থাৎ পৃথিবীতে অনেক পেশা রয়েছে, অনেক কিছু করার রয়েছে। তবে আমাদের বাবা-মায়েরা বলে লেখাপড়া করতে হবে। লেখাপড়া দিয়েই তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে। এ ছাড়া তার মধ্যে আর কোনো প্রতিভা আছে কি না, সম্ভাবনা রয়েছে কি না সেদিকে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি না।
প্রশ্ন : যদিও লেখাপড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এর দরকার রয়েছে। তবে এটি জীবন-মরণ হিসেবে নেওয়ার কথা নয়?
উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন, পড়াশোনার দরকার রয়েছে। পড়াশোনা মানুষকে আলোকিত করে। মানুষের ভেতরের সুকুমার বৃত্তিগুলো জাগিয়ে তোলে। পড়াশোনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সে কারণেই।
প্রশ্ন : কিশোর বয়সের একটি ছেলেমেয়ে তার মধ্যে আচরণগত কী ধরনের পরিবর্তন দেখলে তার কাছের মানুষের সতর্ক হতে হবে, যাতে সে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের দিকে যেতে না পারে? কী কী আচরণগত সমস্যা ধরা পড়বে?
উত্তর : তরুণ বয়সে সাধারণত আবেগতাড়িত হয়ে করে। মোবাইল চেয়েছিল, মোবাইল বাবা দেয়নি। অভিমান করে আত্মহত্যা করে। অথবা প্রেম করছিল, ব্রেকআপ হয়ে গেল; সেখান থেকে মনে হলো সব শেষ হয়ে গেছে। তার জীবনের চাওয়া-পাওয়া প্রতিষ্ঠা, তারা তাৎক্ষণিকভাবে না পেলে মনে করে এই জিনিসটি পাইনি। আমার জীবনে আর কিছু নেই। আত্মহত্যা করে কিন্তু মোটামুটি কয়েকটি কারণে। একটি হলো পরিস্থিতি তো খারাপ হতেই পারে। জীবন তো সব সময়ই যে একেবারে আমার অনুকূলে থাকবে, পক্ষে থাকবে এমন তো নয়। এই যে বিরূপ পরিস্থিতি, আসলে হতাশা সহ্য করার শক্তি থাকতে হয়। হতাশা সহ্য করার শক্তি একেকজনের একেক রকম।
আরেকটি হচ্ছে রেজিলেন্স । এটি হলো বিপর্যয়ের পরে দ্রুত নতুন করে দাঁড়িয়ে যাওয়া, আবার হাঁটা শুরু করা। এটা তো সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে। জাতীয় দুর্যোগগুলো হয়, তখন কি আমরা ভেঙে পড়ি? তারপরও তো আবার নতুন করে জীবিকা নির্বাহ করি। আমাদের জাতির ভেতর এটি রয়েছে। তবে আমাদের তরুণদের মধ্যে এটা দিতে পারছি না। বিপর্যয়ের পর দ্রুত দাঁড়িয়ে যাওয়া অথবা হতাশা আসলে তাকে সহ্য করে নেওয়া অথবা পরীক্ষা বা প্রেম এগুলো জীবনের মূল জিনিস—এতে ব্যর্থ হওয়া মানে আমার জীবনে আর কিছু নেই। আরেকটি হচ্ছে অবাস্তব প্রত্যাশা করা অথবা একমুখী চিন্তা করা, আমাকে শুধুই এটি পেতে হবে। এই প্রেম ব্যর্থ হওয়া মানেই সব শেষ। আরো তো অপশন রয়ে গেছে। অথবা আমি রেজাল্ট ভালো না করতে পারি, আমি খেলাধুলা করতে পারি, অথবা কিছু না করলেও আমি আমার মতো একটি জীবন তো বেছেও নিতে পারব। জীবনটা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। একজন ভালো মানুষ হওয়া সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। এই ভিত্তিটা আমাদের পরিবারকে আমাদের দিতে হবে। তুমি ভালোভাবে মানুষ হও এবং জীবনের প্রতি আসক্ত হও। মরণের প্রতি কেন আসক্ত হবা?