শিশুর চোখ দিয়ে পানি পড়ার চিকিৎসা কী?

অনেক শিশুরই দেখা যায় চোখ দিয়ে পানি পড়ার সমস্যা হচ্ছে। সময়মতো চিকিৎসা করলে এর জটিলতা এড়ানো যায়। আজ ৫ জানূয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৫৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মো. ফরহাদ হোসেন। বর্তমানে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক অফথালমোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : শিশুদের চোখ থেকে পানি পড়ার কারণগুলো কী?
উত্তর : আমাদের দেশের শতকরা ছয়জন বাচ্চার চোখ থেকে পানি পড়ে। এটা আমরা স্বাভাবিকভাবে পেয়ে থাকি। তবে ইদানীং এই রোগটি খুব বেশি দেখছি। এটাকে রোগ হিসেবে বলছি এই কারণে যে, সঠিক সময়ে এর যদি সঠিক চিকিৎসা করা না হয়, তবে নানা ধরনের জটিলতায় শিশুর দৃষ্টির ক্ষতি হতে পারে। চোখ দিয়ে পানি পড়ার কারণ বলতে গেলে আমরা প্রথম যেটা বুঝি, আমাদের চোখের ঠিক কোণায় একটি গ্রন্থি আছে। এই ল্যাকরিমাল গ্রন্থি থেকে পানি বের হয়। সেটা মণিকে সিক্ত রাখে, চোখ সিক্ত রাখে। এরপর চোখের কোণায় দুটো ছিদ্র রয়েছে, যাকে বলা হয় পাংটা, এরপর একটি পথ রয়েছে এর মধ্য দিয়ে পানি নাকের ভেতর দিয়ে চলে যায়। এটি স্বাভাবিক পদ্ধতি। যদি কোনো কারণে এই পথ বন্ধ থাকে, শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মগত কারণে ছিদ্রটি তৈরি হয়নি। সেই কারণে ছিদ্রের ভেতর দিয়ে না বেরিয়ে পানিটা গড়িয়ে আসে। আবার দেখা যায়, এই রাস্তা দিয়ে ঢুকল ঠিকই, তবে স্যাক নামক একটি জায়গা আছে, যাকে বলা হয় ল্যাকরিমাল স্যাক। এটি থলের মতো, পানিটা এসে এই থলির ভেতর জমা থাকে। যদি থলিতে কোনো সমস্যা থাকে। তাহলে পানি আর পেছনের দিক থেকে নাকে যেতে পারবে না। সাধারণত পূর্ণ বয়স্ক বাচ্চা বা ফুল টার্ম বেবি যারা জন্মগ্রহণ করে, সে সমস্ত শিশুদের রাস্তাটি খুলে যায় জন্মের পরেই। তবে যদি অপরিপক্ব শিশু যদি হয়, তখন পথটি তার পরিষ্কার হয় না। পরিষ্কার না হলে, পানি তার পথ দিয়ে যেতে পারবে না। এখানে জমা হয়ে একটি সংক্রমণের তৈরি করবে।
আবার দেখা যায়, ছোট ছোট বাচ্চা তাদের নখ সাধারণত বড় থাকে। হয়তো বা কোনোভাবে হাতের আঙুল লেগে, কালো মণিতে ক্ষত হলো। এই ক্ষত যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়া হয়, পরবর্তীকালে কালো মণির জন্য তার দৃষ্টিহানি হবে।
আবার চোখের যদি চাপ বেড়ে থাকে, তবে তার প্রাথমিক পর্যায়ে চোখ দিয়ে পানি আসে। সুতরাং শিশুর চোখের পানি পড়লে অনেক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন : শিশুর চোখে পানি পড়া যে একটি রোগের কারণে বা সমস্যার কারণে হচ্ছে, সেটি কী করে বাবা-মা বুঝবে?
উত্তর : আসলে যখনই চোখ দিয়ে পানি পড়বে, তখনই চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়া প্রয়োজন। আমি মনে করি, আরো ভালো হয় শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে। প্রাথমিক অবস্থায় আসলে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করি দেখা যায়, চোখের কোনো জটিলতা হবে না, ক্ষতি হবে না।
প্রশ্ন : তবে কিছু কিছু সময় আছে যখন একটি শিশু বলতে পারবে না তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ওই সময়ে বাবা-মায়েরা কোন বিষয় দেখে বুঝবেন?
উত্তর : প্রায় শতকরা ১০ ভাগ বাচ্চার নেত্রনালির রাস্তার পেছনে যে ন্যাজোল একটিমাল ডাক্ট, এটা বাধাগ্রস্ত থাকে। অর্থাৎ পুরোপুরি খোলেনি। সাধারণত জন্মের চার সপ্তাহ পরে পানি পড়াটা বেশি খেয়াল করা যায়। প্রথম দিকে একটু কম থাকে। কারণ ল্যাকরিমাল গ্রন্থি যেটা থেকে পানি বের হয়, সেটা একটু কম থাকে। যেহেতু পানিটা কম বের হয়, তাই প্রথম চার সপ্তাহে অল্প অল্প করে আসতে পারে বা না-ও আসতে পারে। তবে চার সপ্তাহের পর যখন মা দেখবেন তার বাচ্চার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে শুধু ম্যাসাজ করলেও অনেক ভাগ শিশু ভালো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : প্রাথমিক পর্যায়ে এলে আপনারা চিকিৎসার জন্য কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাছে যখন প্রথম আসে, আমরা দেখি আসলে কোন কারণে তার সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চাদের চোখের যে দুটো ছিদ্র, যাকে বলা হয় পাংটা, সেটি হয়তো বন্ধ রয়েছে, তখন আমরা একে খুলে দেওয়ার চেষ্টা করি। আর যদি দেখি সেটি ঠিক আছে, তখন আমরা দেখি কালো মণিতে কোনো সমস্যা আছে কি না, বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না। তার চোখের চাপ ঠিক আছে কি না। এটা আমরা দেখলে বুঝতে পারি। কী কারণে সমস্যা হচ্ছে সেটি আমরা বের করি। যদি দেখি নেত্রনালি, অর্থাৎ যে রাস্তা দিয়ে পানিটা বের হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে সমস্যা, তখন আমরা বলি ম্যাসাজ করার জন্য। ৯৬ থেকে ৯৮ ভাগ বাচ্চার শুধু এই নেত্রনালিতে যদি যথাযথ ম্যাসাজ করা যায় তাহলে ঠিক হয়ে যায়। আমরা চিকিৎসকরা বলে দিই। চোখের ঠিক কোণায় একটু চাপ দেবেন। কয়েকবার চাপ দেওয়ার পর দেখা যাবে, চোখ দিয়ে পানি একটু বেশি আসবে। তখন একটু তুলা ভিজিয়ে চিপে পানি মুছে নেন। মুছে নেওয়ার পর আবার একটু আলতো চাপ দিয়ে পাঁচবার ম্যাসাজ করেন। যদি এই ম্যাসাজ করা হয়, এতেই অনেকটা ভালো হয়ে যায়।
তবে অনেকে ভয়ের কারণে, বাচ্চা ব্যথা পাবে, এই ভেবে চাপ দিয়ে ম্যাসাজ না করে, আস্তে আস্তে করে টেনে ম্যাসাজ করেন। তাতে কোনো উপকার হয় না। বরং আমি মনে করি এর সঠিক প্রক্রিয়া জানতে হবে। এবং অবশ্যই চাপ দিতে হবে, ঠিক কোণাতে। চোখের বাইরে নেত্রনালি যেখানে মিলছে ঠিক সেই জায়গায়।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন ৯৬ ভাগ ভালো হয় এভাবে। বাকি যে সমস্যা, যাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : ম্যাসাজের ফলাফল এক বছর পর্যন্ত, ৯৬ থেকে ৯৮ ভাগ পাওয়া যাবে। এক থেকে দুই বছরের ক্ষেত্রে যদি দেখি রোগীর কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তখন আমরা দুই বছরের মধ্যে কোনো একসময়ে অজ্ঞান করে, আমাদের একটি তারের মতো যন্ত্র রয়েছে, সেটি দিয়ে আমরা সেই রাস্তাটিকে পরিষ্কার করে দিই। এটি করলে যাদের সমস্যাটি রয়ে গেছে তাদের মধ্য থেকে ৯৫ ভাগ শিশুর বিষয়টি ভালো হয়ে যায়। আবার যাদের এটি করার পরও ভালো হলো না, বাদ থাকল তাদের ক্ষেত্রে আগে বলা হতো, বড় হলে কেটে অস্ত্রোপচার করে দেব। একে বলা হয় ডিসিআর। ডেকরোসিস্টো রাইনোসটোমি।
তবে সম্প্রতি আমি কিছু তথ্য পেলাম। ভারতে এর আধুনিক কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি বের হয়েছে, সার্জারি না করে এখন টিউব ইনটুবিশনও করা যায়।