বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস
ডায়াবেটিস থেকে সাবধান
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/04/07/photo-1460005046.jpg)
আজ ৭ এপ্রিল পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে মূল বিষয় ডায়াবেটিস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করুন : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন’।
বেশ কয়েক বছর ধরে ডায়াবেটিস রোগটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। কারণও আছে। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছেই। ২০১২ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। গবেষকরা বলছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা ৭০ কোটিতে যাবে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, এ রোগে আক্রান্তের প্রায় ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের দেশের মানুষ। ২০১২ সালের আরেকটি পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, ডায়াবেটিসে প্রায় ১৫ লাখ লোক মারা যান।
আমাদের দেশের অবস্থাও কিন্তু বেশ ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল অবধি ডায়াবেটিস রোগে এ দেশে আক্রান্ত হয়েছে ৭১ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, বাংলাদেশে ৮৪ লাখের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে।
ডায়াবেটিস হলো হরমোনজনিত রোগ। শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাব হলে বা এ হরমোন ঠিকমতো কাজ না করলে এ রোগ দেখা দেয়। মা-বাবা, ভাইবোন কারো ডায়াবেটিস থাকলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
আমাদের এখনকার জীবনমানের কারণেও বাড়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। আগের মানুষরা কঠোর পরিশ্রম করতেন। কৃষিপ্রধান অর্থনীতির কারণে বেশির ভাগ লোকই নিজের জমিতে কাজ করতেন। মেয়েরা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। এতে কিন্তু তাঁদের শরীরে রোগের বাসা কমই বাঁধত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ আর শারীরিক পরিশ্রম করতে চায় না। নিজের কাজ নিজে করে না। এতে শারীরিক পরিশ্রম হয় না। পরিশ্রম না হওয়ায় বেড়ে যায় উচ্চ রক্তচাপ, মুটিয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি।
ফাস্টফুড না হলে অনেকের চলেই না। ফাস্টফুড শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এতে বাড়ে মুটিয়ে যাওয়ার হার। দেশে মুটিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এটিও কিন্তু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
এ ছাড়া বিভিন্ন রোগেও ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়, হরমোনের রোগ। এ ছাড়া কিছু কিছু ওষুধ সেবনে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা থাকে, যেমন : স্টেরয়েড, ফেনিটইন ইত্যাদি।
লক্ষণ
ডায়াবেটিসকে বলা হয় নীরব ঘাতক। খুব নির্দিষ্ট উপসর্গ না থাকায় এ রোগে আক্রান্ত হলেও অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যেমন বুকে ব্যথা হলে আমরা কিন্তু চিন্তা করি হার্টের ব্যথা নয় তো? ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এমনটা নেই। দীর্ঘদিন কোনো চিকিৎসা না করায় জটিল আকার ধারণ করে।
তার পরও কিছু কিছু লক্ষণকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা যায়। এ লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে অতিরিক্ত পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব, রাতে বারবার প্রস্রাব হওয়া, অতিরিক্ত দুর্বল লাগা, শক্তি না পাওয়া, ওজন কমা, মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি খুব ঝোঁক, ঘন ঘন ইনফেকশন। পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে তো কথাই নেই। ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা সেখানে বেড়ে যায়।
কখন পরীক্ষা করাবেন
অনেকে জানতে চান, ডায়াবেটিসের জন্য রক্ত পরীক্ষা কোন বয়স থেকে করাতে হবে? আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বয়স ৪০-এর বেশি হলে প্রতি তিন বছর পরপর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। ডায়াবেটিসের জন্য ফাস্টিং ব্লাড সুগার বা এইচবিএ১সি পরীক্ষা করাতে হয়। যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে, পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকে, কোলেস্টেরল বেশি থাকে, ধূমপান করেন, তাহলে আরো কম বয়সে ও ঘনঘন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে।
যদি ফাস্টিং ব্লাড সুগার ৭ মিলিমোল/লি বা এইচবিএ১সি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যদি ফাস্টিং ব্লাড সুগার ৬ দশমিক ১ থেকে ৬ দশমিক ৯ বা এইচবিএ১সি ৬ দশমিক শূন্য থেকে ৬ দশমিক ৪-এর মধ্যে হয়, তবে আপনি ডায়াবেটিক কি না তা জানার জন্য ওজিটিটি নামক আরেকটি পরীক্ষা করতে হবে। এমনটি হলে আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যদি ফাস্টিং ব্লাড সুগার ৫ দশমিক ৫-এর কম বা এইচবিএ১সি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের কম হয়, তাহলে আপনি রক্ষা পেলেন। তিন বছর পর পর আবার পরীক্ষা করান।
নিয়ন্ত্রণ করুন ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস যদি ধরা পড়ে, তবে দুশ্চিন্তা করবেন না। ডায়াবেটিসের অনেক ভালো চিকিৎসা আছে। আপনি ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলেই ওষুধ খেতে হবে, এমনটি নয়। যদি নিয়ম মেনে চলতে পারেন ও জিহ্বাকে সংযত করতে পারেন, তবে আপনার ওষুধের প্রয়োজন নাও হতে পারে।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় তিনটি ‘ডি’ খুব পরিচিত। তিন ‘ডি’-তে বোঝায় ডায়েট কন্ট্রোল (খাবারে নিয়ন্ত্রণ), ডিসিপ্লিন (নিয়মানুবর্তিতা) ও ড্রাগ (ওষুধ)। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ডায়েট কন্ট্রোল ও ডিসিপ্লিন মানার মাধ্যমে ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই ডায়েটের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
খাবার হতে হবে স্বাস্থ্যকর। শর্করাজাতীয় খাবার কম খেতে হবে। বাসমতী চাল, স্পাগোটি, নুডলস, আটার রুটি খাওয়া যায়। এগুলো রক্তে সুগার বেশি বাড়ায় না। চর্বিযুক্ত খাবার থেকে সাবধান। তবে অলিভ অয়েল, বাদাম এগুলো খেতে পারেন। মাছের তেল খেতে পারেন। লবণ বেশি নয়। দিনে সব ধরনের খাবারে ছয় গ্রামের বেশি লবণ নয়। অ্যালকোহলকে না বলুন। ধূমপান করবেন না। মিষ্টি খেলে সুগার বাড়ে বেশ। খাবেন না, একেবারেই তা নয়। তবে পরিমাণে কম খান। যেদিন মিষ্টি খাবেন, সেদিন অন্য খাবার কম খান। ইনসুলিন নিলে ডোজ একটু বাড়িয়ে দিন।
আঁশজাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খান। এটি রক্তে সুগার ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। আঁশ পাবেন শাকসবজি, ফলমূলে।
ওজন রাখুন নিয়ন্ত্রণে। ওজন বেশি হলে ইনসুলিন কাজ করতে পারে না। ফলে ডোজ বেশি লাগে।
প্রতিদিন ব্যায়াম করুন। হাঁটা খুব ভালো ব্যায়াম। সাইক্লিং করতে পারেন। সম্ভব হলে সাঁতার কাটতে পারেন। বয়স্করা কিন্তু তরুণদের মতো কঠোর ব্যায়াম করতে যাবেন না। আপনার জন্য প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা ভালো। আবার একেবারে আস্তে হাঁটবেন না। এমনভাবে হাঁটুন যেন ঘাম ঝরে।
যদি এতেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে ওষুধপাতি সেবন করতে হবে। আপনার চিকিৎসক ঠিক করবেন কোন ওষুধ আপনার জন্য ভালো।
মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে আপনি কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে পারবেন। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত হলেই বিপদ। আপনার হতে পারে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অন্ধত্ব, কিডনির জটিলতা। তাই সচেতন হন।
অনেকে ওষুধ বন্ধ করে দেখেন ওষুধ ছাড়া সুস্থ থাকেন কি না। এটা কিন্তু খুবই মারাত্মক। ডায়াবেটিস একবার ধরা পড়লে তা কখনই সাড়ে না। অযথা বিপদ ডেকে আনা কি বুদ্ধিমানের কাজ? তাই সচেতন হোন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।