অটিজম : শিশুদের চাই ভালোবাসা

আগামীকাল ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অটিজম সচেতনতা থেকে সক্রিয়তা, একীভূত সমাজের শুভ বারতা’। অটিস্টিক রোগীর সংখ্যা সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে অটিজম ছিল প্রতি ১০১ জনে একজন। ২০১০ সালের পর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি ৬৮ জনে এক জন।
অটিজম এবং কর্মসক্ষমতা এই বিষয়টিকে এ দিবসের স্লোগান হিসেবে তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী অটিজম দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে এবার। কেননা সমগ্র বিশ্বে এখনো অটিজম আক্রান্তদের শতকরা ৮০ ভাগ পরিণত বয়সে বেকারত্বের গ্লানি বহন করতে হচ্ছে।
অটিজম হচ্ছে মস্তিষ্কের বিন্যাসগত সমস্যা। অটিজম শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। এটি হলে শিশু কেবল নিজের জগতে আচ্ছন্ন থাকে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শিশু যখন শুধু নিজের মধ্যে আচ্ছন্ন থাকে তখন তার অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ, সামাজিকতা, কথা বলা, আচরণ ও শেখা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
অটিজম বিষয়ে প্রথম ধারণা দেন হেনরি মোস্লে নামে একজন ব্রিটিশ সাইকিয়াট্রিস্ট, ১৮৬৭ সালে। পরবর্তীকালে লিও ক্যানার নামক একজন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট, ১৯৪৩ সালে এই অসুখের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন এবং এর নাম দেন ইনফেনটাইল অটিজম ।
সাধারণত শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ছেলেশিশুদের মধ্যে অটিজম হওয়ার হার মেয়েশিশুদের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি।
অটিজম বলতে শুধুমাত্র একটি অসুখকে বোঝায় না, আসলে এটি কয়েকটি অসুখের সমষ্টি। যাকে বলে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার এর মধ্যে আছে-
ইনফেনটাইল অটিজম
এই ধরনের শিশুদের সামাজিক আচরণ, পারস্পরিক যোগাযোগ ও ক্রিয়াকলাপের সমস্যা এবং পুনর্বৃত্তিমূলক আচরণ সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।
রেটস সিনড্রম
এই রোগ শুধু মেয়েদের হয়ে থাকে। এক বছর পর্যন্ত শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে। তারপর তার সামাজিক ও মানসিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
এ্যাজপার্গার সিনড্রোম
এ রোগ সাধারণত ছেলেদের হয়। এরা কিছু কিছু কাজ বা আচরণ বারবার করতে থাকে। তবে কথা ঠিকমতো বলতে পারে। এরা একাকি এবং আলাদা থাকে। তবে কিছু কিছু ছোট ব্যাপারে এদের মধ্যে অধিক আগ্রহ দেখা যায়।
চাইল্ডহুড ডিসইনটেগ্রেটিভ ডিসঅর্ডার
এর আরেক নাম হেলারস ডিজিস। এদের সাধারণত দুই বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে । পরবর্তী সময়ে এদের সামাজিক আচরণে সমস্যা দেখা যায়। এদের সাধারণত স্নায়বিক সমস্যা বেশি থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আটিপিক্যাল ও অন্যান্য সমস্যাজনিত অটিজম।
যেভাবে বুঝবেন শিশু অটিস্টিক
অন্য সব শিশুর মতোই প্রতিটি অটিজম আক্রান্ত শিশু আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবে যে প্রধান চারটি সমস্যা সব অটিস্টিক শিশুর মধ্যে দেখা যায় সেগুলো হলো :
- স্বাভাবিক সামজিক আচরণগত সমস্যা।
- পারস্পরিক যোগাযোগ সমস্যা।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এবং ক্রিয়াকলাপ সমস্যা।
- স্বাভাবিক ও সামাজিক আচরণগত সমস্যা।
এ ছাড়া অটিস্টিক শিশুর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য
• এরা সাধারণত একা একা থাকে।
• অন্যদের সাথে মিশতে, খেলতে এবং কথা বলতে চায় না।
• কথা বললেও অটিস্টিক শিশুরা অন্যের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে চায় না।
• মানুষের প্রতি আগ্রহ কম প্রদর্শন করে।
• কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক আচার-আচরণের উন্নতি হলেও সামাজিক দায়িত্ব, ভাববিনিময় ও অপরের প্রতি সহানুভূতির সমস্যা রয়ে যায়।
• অটিস্টিক শিশুদের আদর-ভালোবাসার প্রতি আকর্ষণ কম । যেমন : তাকে কোলে নেওয়া বা আদর করা সে পছন্দ করে না। তবে অনেক অটিস্টিক শিশু তার প্রতি বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা বোঝে।
• বন্ধুবান্ধবের সাথে খুব কম মেশে।
• অকারণে হাসে, কাঁদে বা ভয় পায়।
• প্রথাগত শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কম কিন্তু ছোট ছোট বস্তুর প্রতি আগ্রহ বেশি।
• বিপদ সম্পর্কে অসচেতন।
• যে কোনো বিষয় কেউ কেউ অতিমাত্রায় সতর্ক আবার কেউ কেউ মোটেই সতর্ক নয়।
• অনেকে বেশি শব্দ অপছন্দ করে।
অটিজমের সঙ্গে প্রায়ই যে সমস্যাগুলো দেখা যেতে পারে, তা হলো—অতি চঞ্চলতা ও অমনোযোগিতা, হঠাৎ অতিমাত্রায় রাগ করা, খিঁচুনি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, নিজেকে আঘাত করা, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যাভ্যাসজনিত সমস্যা ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলো বাদ দিয়ে অটিজমের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বাবা-মা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
অনেক সময় বাবা-মা শিশুর অটিজমের জন্য নিজেদের দায়ী করেন। তবে অটিজমের জন্য কোনোভাবেই বাবা-মা দায়ী নন। অযথা ধৈর্যহারা না হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। শিশুটির সক্ষমতার দিকে লক্ষ রেখে প্রথমে তাকে মূলধারার স্কুলে অন্য সব শিশুর সঙ্গে শিক্ষা দিতে হবে এবং প্রয়োজনে বিশেষ সহায়তা দিতে হবে।
যেসব শিশু মূলধারা মানিয়ে নিতে একেবারেই সক্ষম নয়, তাদের বিশেষায়িত স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা একেবারেই বাইরের কোনো স্কুলে যেতে পারছে না, তাদের জন্য বাড়িতে উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে নিতে হবে মানসিক প্রস্তুতি।
অটিজম নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, সাইকোলজিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, সমাজকর্মী, বিশেষায়িত স্কুলের প্রশিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, একটি শিশুর অটিজমের চিকিৎসা কেবল তাদের কারো একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, সংশ্লিষ্ট সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। যে শিশুটির অটিজম আছে, তাকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাই হতে হবে সবার অভিন্ন লক্ষ্য।
ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার, সহকারী অধ্যাপক, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল