শর্তসাপেক্ষে অস্ত্র সমর্পণে রাজি ভারতের মাওবাদী নেতৃত্ব

শর্তসাপেক্ষে অস্ত্র সমর্পণে রাজি হয়েছে ভারতের মাওবাদী নেতৃত্ব। মাওবাদীদের এমনই একটি চিঠি হাতে এসেছে বলে জানিয়েছেন ছত্তিশগড়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। চিঠি যাচাই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের প্যাডে লেখা একটি চিঠি জনসমক্ষে এসেছে। সেই চিঠিতে এক মাওবাদী শীর্ষ নেতার ছবিও আছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্ব অস্ত্র সমর্পণ করে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তবে, সরকারকে এবিষয়ে নির্দিষ্ট মতামত জানাতে হবে। চিঠিতে বলা হয়েছে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং সরকারের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্ব। পাশাপাশি জেলবন্দি ‘কমরেড’ এবং অন্যান্য জায়গায় থাকা দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পরিসর তৈরি করে দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে ওই চিঠিতে।
সূত্র মারফত এই চিঠি ডিডাব্লিউয়ের হাতে এসে পৌঁছেছে। ডিডাব্লিউ এই চিঠির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। তবে চিঠি সরকারের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ছত্তিশগড়ের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজয় শর্মা জানিয়েছেন, এমন একটি চিঠি তাদের হাতেও এসেছে। চিঠিটি আসল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তার বক্তব্য, “চিঠিটি সত্য হলে এই প্রথম মাওবাদীরা তাদের বিবৃতিতে কারো ছবি ব্যবহার করলো।” বিজয় শর্মার কথায়, “গণতন্ত্রে কখনো শর্তসাপেক্ষে আলোচনা হয় না। মাওবাদীরা আবার শর্তের কথা জানিয়েছে। তবে চিঠিটি যাচাই করার পর আমরা সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবো এবং আমাদের বক্তব্য জানাবো।”
বিজয়ের বক্তব্য, মাওবাদীদের জন্য এখনো অস্ত্র সমর্পণ করে মূলস্রোতে ফিরে আসার সুযোগ আছে। এ নিয়ে সরকার তাদের বক্তব্য আগেই জানিয়েছিল।
মঙ্গলবার মাওবাদীদের যে চিঠি প্রকাশ্যে এসেছে, সেটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে। ছত্তিশগড়ের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী প্রথম ব্যক্তি, যিনি সরকারের তরফে এই চিঠি হাতে আসার কথা স্বীকার করলেন। বস্তুত, ছত্তিশগড়ের বস্তার মাওবাদীদের সবচেয়ে শক্তিশালী অঞ্চল বলে গণ্য করা হয়। গত মে মাসে এই অঞ্চলেই সশস্ত্র মাওবাদীদের সঙ্গে দেশের আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের তুমুল সংঘাত হয়েছিল। ওই ঘটনায় ২৮ জন মাওবাদী নিহত হয়েছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম মাওবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক বাসবরাজু।
এদিন যে চিঠিটি প্রকাশ্যে এসেছে, সেখানে সই করেছেন মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র ‘অভয়’। যার ছবি চিঠিতে ব্যবহার করা হয়েছে, তিনি মাওবাদী নেতা বেনুগোপাল বলে মনে করা হচ্ছে। বেনুগোপাল মাওবাদী দলের অন্যতম শীর্ষনেতা। একসময় মাওবাদী দলের শীর্ষনেতা ছিলেন কিষেণজি। বেনুগোপাল তার ভাই। কিষেণজি পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে নিহত হন।
এদিনের চিঠিতে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং ইমেল অ্যাড্রেস দেওয়া হয়েছে। ওই ঠিকানাতেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ভিডিও কলে সরকারের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার কথা জানানো হয়েছে চিঠিতে। শুধু তা-ই নয়, একমাস সময় চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছে।
মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্বকে উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, বাসবরাজু সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন আলোচনার রাস্তা তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল। যুদ্ধবিরতির কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও সরকার বাহিনী পাঠিয়ে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই পথ থেকে সরে আসতে চান না মাওবাদী নেতৃত্ব। তাই এবার অস্ত্র সমর্পণ করে আলোচনায় বসতে তারা রাজি। তাদের বক্তব্য, এরপর অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে’ মূলস্রোতের আন্দোলনে যোগ দিতে চান তারা।
ছত্তিশগড়ের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, মাওবাদীদের সঙ্গে সরকারের কোনো যুদ্ধ চলছে না, ফলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ‘অপ্রাসঙ্গিক’। বস্তুত, মঙ্গলবার বেশি রাতে ছত্তিশগড় পুলিশের আইজি (ইনস্পেক্টর জেনারেল) পি সুনদারাজও এমন একটি চিঠি পাওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘চিঠিটি ঠিক কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এবিষয়ে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তা সরকার নেবে।’
এদিকে ডয়চে ভেলে জানতে পেরেছে, চিঠির বয়ানের সঙ্গে মাওবাদী নেতৃত্বের সকলে সহমত নন। এবিষয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনার সুযোগও পায়নি কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটির যে নেতারা একসঙ্গে আছেন, তারা আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারের কাছে একমাস সময় চাওয়া হয়েছে সে কারণেই। এর মধ্যে যে নেতারা জেলে আছেন, যারা অন্য রাজ্যে আছেন, তাদের সঙ্গেও আলোচনা করে নিতে চাইছে কেন্দ্রীয় কমিটি।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্যণীয়। যে চিঠিটি হাতে এসেছে, তাতে তারিখ দেওয়া আছে ১৫ আগস্ট। এতদিন পর চিঠিটি প্রকাশ্যে এলো কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সূত্র জানাচ্ছে, চিঠিটি জঙ্গলে বসে লেখা। গত কয়েকমাস ধরে মাওবাদীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীর লাগাতার লড়াই চলছে। মাওবাদী শীর্ষ নেতারা ক্রমাগত জায়গা বদল করছেন। তাই চিঠিটি বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়নি। কিছুদিনের মধ্যে বাকি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মাওবাদীরা আরো একটি চিঠি হালনাগাদ করে প্রকাশ করতে পারে বলে জানা গেছে।
তবে অস্ত্র সমর্পণ করে মাওবাদীদের আলোচনায় বসতে চাওয়ার ঘটনা অভূতপূর্ব বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।