নিজের ছবি দেখতেই ভয় পেতেন আলফ্রেড হিচকক

সারা বিশ্বে আলফ্রেড হিচকক পরিচিত ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ হিসেবে। প্রায় ছয় দশকের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এই ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন অসাধারণ কিছু রোমহর্ষক ও রোমাঞ্চকর ছবি। এখনো থ্রিলার কিংবা সাসপেন্স নিয়ে কাজ করা বিশ্বের প্রায় সব চলচ্চিত্রনির্মাতা হিচককের ছবি থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণার কথা চোখ বুজে স্বীকার করেন। ‘লাইফ বোট,’ ‘রিয়ার উইন্ডো,’ ‘সাইকো’ কিংবা ‘ভার্টিগো’-এর মতো অসাধারণ ছবির পরিচালক তিনি। আজ ২৯ এপ্রিল, হিচককের প্রয়াণ দিবস। দিনটি উপলক্ষে ‘দ্য এফডব্লিউ’ এবং ‘ডিগ্রিড’-এর অবলম্বনে জেনে নিন কিছু বিচিত্র তথ্য।
১. যদি হিচককের ভয়ংকর চলচ্চিত্রগুলো দেখতে আপনি ভয় পেয়ে থাকেন, তবে জেনে নিন এই দলে আপনি একা নন। স্বয়ং হিচককই নিজের পরিচালিত ছবিগুলো দেখতে ভয় পেতেন। ১৯৬৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিজের ছবি দেখতে ভয় পাই। কখনোই ছবিগুলো দেখতে চাই না। না-জানি মানুষ কীভাবে দেখে আমার ছবি!’
২. শুধু নিজের ছবি নয়, আরো অনেক কিছু নিয়ে তাঁর ভীতি ছিল উল্লেখ করার মতো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ডিম! ডিম ফাটানোর পর কুসুম দেখলে অস্বস্তিকর লাগত তাঁর। এ ছাড়া ভয় পাওয়ার কোনো কারণ না থাকলেও হিচকক পুলিশ দেখলেই ঘেমে উঠতেন।
৩. ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ পর্দার পেছনে, অর্থাৎ বাস্তব জীবনেও যেন কম যান না। ভয়ংকর এবং নিষ্ঠুর সব ঠাট্টা করে তিনি তাঁর ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী আর সহকর্মীদের ঘাবড়ে দিতে ভালোবাসতেন। ‘দ্য থার্টি নাইন স্টেপস’-এর সেটে ছবির একটি দৃশ্যের জন্য তিনি রবার্ট ডোনাট ও মেডিলিন ক্যারলকে একসঙ্গে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেন। কিন্তু দৃশ্য ধারণ শেষ হলে হিচকক হ্যান্ডকাফের চাবি হারিয়ে ফেলার ভান করতে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা ছবির নায়ক-নায়িকাকে এইভাবে বন্দী রাখার পর তিনি ফাঁস করেন তাঁর পরিকল্পিত ঠাট্টার কথা।
৪. হিচকক তাঁর একটি ছবির শুটিংয়ের জন্য ডিজনিল্যান্ডকে বেছে নেন। কিন্তু তাতে সায় দেয়নি ডিজনি। কারণ, ‘সাইকো’-এর মতো কোনো ছবির পরিচালকের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার কোনো আগ্রহ তাঁদের ছিল না।
৫. অথচ এই ‘সাইকো’ ছবিটি পরিচালনা করার সময় তিনি কম কষ্ট করেননি। উপন্যাসভিত্তিক এই ছবির আসল উপন্যাসের সব কপি তিনি একবার কিনে ফেলার চেষ্টা করেন! কারণ, আগে থেকে কাহিনী জানা থাকলে অনেকেই হয়তো তাঁর ছবি দেখে মজা পাবে না।
৬. তাঁর পরিচালিত ৫২টি ছবির মধ্যে ৩৭টিতেই তাঁকে দেখা গিয়েছে পর্দায়। অবাক হচ্ছেন? ক্যামিও অভিনয়ের রাজা ছিলেন তিনি। আপনার চোখ ফাঁকি দিয়েই তিনি ‘দ্য বার্ডস’, ‘সাইকো’ আর ‘রোপ’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলোর পর্দায় ঘুরে বেড়িয়েছেন।
৭. হিচকক বিশ্বাস করতেন, তাঁর ছবিগুলো দেখার জন্য একটু বিশেষ দৃষ্টি কিংবা সময় রয়েছে। তাই তাঁর বিখ্যাত পাঁচটি ছবির (দ্য ম্যান হু নো টু মাচ, রিয়ার উইন্ডো, রোপ, দ্য ট্রাবল উইথ হ্যারি এবং ভার্টিগো) স্বত্ব তিনি কিনে নেন এবং প্রাথমিকভাবে প্রদর্শনের পর থিয়েটার থেকে সরিয়ে ফেলেন ছবিগুলো। প্রায় ৩০ বছর এই ছবিগুলো তখন কেউ দেখতে পায়নি। হিচককের মৃত্যুর পর তাঁর উইলপ্রাপ্ত কন্যা প্যাট্রিসিয়া আবার ছবিগুলো প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করেন।
৮. জিমি স্টুয়ার্ট আর হিচকক জুটির অসাধারণ কাজ দেখা গেছে ‘রিয়ার উইন্ডো’ কিংবা ‘ভার্টিগো’ চলচ্চিত্রগুলোতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বক্স অফিসে ‘ভার্টিগো’ মুখ থুবড়ে পড়লে হিচকক তাঁর পরবর্তী ছবিতে জিমি স্টুয়ার্টের বদলে অন্য অভিনেতাকে নিতে চান। কিন্তু এই কথা স্টুয়ার্টকে জানানোর মতো কঠিন হৃদয় ছিল না হিচককের। এমনকি এটি জানাতে পারছিলেন না বলে পরবর্তী ছবি ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’-এর শুটিং শুরু করতে দেরি হয়ে যায় বেশ কয়েক দিন। জিমি স্টুয়ার্ট তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেন যে হিচকক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্টুয়ার্টের হাতে অন্য কোনো ছবি আসার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের ছবির কাজ শুরু করবেন না।
৯. ১৯৭৯ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট আলফ্রেড হিচকককে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে। সে সম্মাননা পাওয়ার পর হিচকক তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা করে বলতে থাকেন যে তিনি খুব শিগগির মারা যাবেন। কিন্তু এক বছর পর তাঁর ঠাট্টাটি নিষ্ঠুরভাবে সত্য হয়ে যায়। ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল মারা যান ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’।
১০. এটি অবিশ্বাস্য! একের পর এক অসাধারণ সব ছবি জন্ম দিলেও তিনি কোনো দিন অস্কার পাননি সেরা পরিচালক হিসেবে। এ ঘটনাকে অনেকে অস্কারের দুর্ভাগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে তাঁর চলচ্চিত্র ‘রেবেকা’ অস্কারে জিতে নিয়েছিল শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফির পুরস্কার এবং তিনি নিজে ভূষিত হন জি থালবার্গ মেমোরিয়াল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে। সে পুরস্কার হাতে পেয়ে তিনি জন্ম দেন অস্কারের মঞ্চে সবচেয়ে ছোট ভাষণের ঘটনা ! মাত্র ৫ শব্দের সে ভাষণে তিনি বলেন, ‘থ্যাংক ইউ।...ভেরি মাচ ইনডিড।’
এভাবেই নিজেকে জাহির না করে আলফ্রেড হিচকক বরং তাঁর ক্যারিয়ারজুড়ে ভেবেছেন দর্শকের প্রয়োজনের কথা। তাই কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে ‘হিচককের ছবি’ মানেই বিশেষ কিছু।