মহৎ পেশার মানুষ
চিকিৎসক ও মানুষ হোন : ডা. স্বপন চন্দ্র

ফ্যাশন তখন রিকো ঘড়ির। দাম অনেক। ছেলেটির খুব শখ হলো রিকো ঘড়ি কেনার। ছেলেটি তখন পড়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। শখ বলে কথা! স্কলারশিপের ৭০০ টাকা দিয়ে ঘড়ি কিনেও ফেলল ছেলেটি। একদিন একজন ডাক্তার বড় ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় পথে দুজন বাবরি চুলওয়ালা লোকের সঙ্গে দেখা হলো। তারা জানাল, ছেলেটির সামনে ঘোর বিপদ আসছে। সামনে একজন সাধু আছেন, ছেলেটি যেন তার সঙ্গে দেখা করে। ছেলেটি তখন ঢাকায় নতুন এসেছে। লোক দুটোর কথায় একটু ঘাবড়ে গিয়ে সেই সাধুর কাছে গেল। সাধুর কাছে যাওয়ার পর তিনি একটি ঠিকানা দিয়ে বললেন, ‘ওখানে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’। বিনিময়ে রেখে দিলেন ছেলেটির সাধের ঘড়ি আর পকেটে যা ছিল সব। সাধুর কথা শুনে ভয়ে ভয়ে ছেলেটি সেই ঠিকানায় পৌঁছে গেল। গিয়ে সাধুর কথামতো কিছুই পেল না। টনক নড়ল তখন।
বুঝল প্রতারকের হাতে পড়েছে।
এভাবেই জীবনপথের নানা মজার গল্প বলছিলেন অধ্যাপক ডা. স্বপন চন্দ্র ধর। এসএসএমসি ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান তিনি। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেলের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে।
বাবা চেয়েছিলেন চিকিৎসক হই
আমার জন্ম হয় কাপাসিয়ার, গাজীপুরে। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। নাম নিহার কান্তিধর। আমাদের ওখানে একজন হাতুড়ে চিকিৎসক ছিলেন, হিরেন চন্দ্র দাস। ছোটবেলায় যখন কোনো অসুখ হতো তাঁর কাছে নিয়ে যেত। উনি যখন সুস্থ করতে পারতেন না, তখন আরেকজন চিকিৎসক ছিলেন অভিরাম মণ্ডল, তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হতো। ডা. অভিরাম মণ্ডলের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে, চরসিন্দুর নামে একটা জায়গা আছে শীতলক্ষ্যার পাড়ে, সেখানে। অভিরাম মণ্ডল ছিলেন এলএমএফ কোর্স পাস। তিনি মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে পাস করে চরসিন্দুর বাজারে প্র্যাকটিস করতেন। প্রচুর লোক তাঁর কাছে যেত। বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমাকে তাঁর মতো চিকিৎসক বানানোর।
আমি মেট্রিক পাস করার পর বাবা বললেন, ‘অভিরাম মণ্ডলের মতো হও।’ আমি ১৯৭০ সালে কাপাসিয়া হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করি। তিনটি বিষয়ে লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পাই সেই সময়। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকা কলেজে সুযোগ পেলাম। তবে হোস্টেলে থাকতে হবে—খরচ বহন করতে পারব না বলে নারায়ণগঞ্জ থেকে আত্মীয়র বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা শুরু করি। ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হই তোলারাম কলেজের নাইট শিফটে। কলেজ থেকে আমাদের বাড়ি ছিল কিছুটা দূরে। যেতে দেরি হতো। সামনের বেঞ্চে জায়গা পেতাম না, পেছনে গিয়ে বসতাম। যখন শিক্ষকরা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন, আমি দ্রুত উত্তর দিতাম। অধ্যাপক পিসি রায় ছিলেন পদার্থের শিক্ষক। ভালো উত্তর দিতাম বলে তিনি আমাকে সামনে নিয়ে বসাতেন।
একাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো। তখন আবার কাপাসিয়া চলে গেলাম। এরপর নারায়ণগঞ্জে আর ফেরা হলো না। কাপাসিয়ায় লেখাপড়া শুরু করলাম। সেখান থেকে দুটো লেটার নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট ডিভিশন পেলাম।
ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলাম। এক বন্ধু বলল, কেমিস্ট্রি নয়, ফার্মেসি ভালো। তখন আবার ফার্মেসিতে ভর্তি হতে চাইলাম। ফার্মেসিতে ভর্তি হলাম। সে সময় দূরের এক আত্মীয় ঢাকায় থাকতেন। নাম স্বপন মিত্র। তাঁর সঙ্গে গিয়ে হলে থাকতাম। তখন আবার ডাক্তারি পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। চেষ্টা শুরু করলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য। এরপর ভর্তি হলাম সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে।
স্ত্রীর প্রতি আমি খুব কৃতজ্ঞ
এমবিবিএস পাস করলাম ভালোভাবে। প্রথম চাকরি হয় কুমিল্লার হোমনায়। এখানের জীবন অনেক সুন্দর ছিল। রোগী দেখতাম, পড়াশোনা করতাম। পাশাপাশি পিজিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করার প্রস্তুতি। নুরুল ইসলাম স্যার ছিলেন তখন পিজির ডিরেক্টর। ১৯৮৪ সালে প্রথম ফার্স্ট পার্ট পরীক্ষা দেই। আমাদের ছিল ছয় মাসের কোর্স। একবারেই পাস করলাম।
এর পর আমাকে সিলেটে পোস্ট দেওয়া হলো। পরে ময়মনসিংসে পোস্ট হলো সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে। ১৯৮৬ সালে এফসিপিএস পার্ট-টু দিতে ঢাকায় চলে আসি। ১৯৮৭ সালের জুলাইতে পার্ট-টু পরীক্ষা দেই। আমি একবারেই পাস করেছি। আমার স্ত্রীর গৌরী ধরের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। সে আমাকে সবসময় সাহায্য করেছে।
এরপর এমডি করি গ্যাস্ট্রোএন্টেরেলোজিতে। পাস করে চলে গেলাম খুলনা মেডিকেলে পরামর্শক হিসেবে। খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে গেলাম ফরিদপুরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। এরপর ঢাকা মেডিকেলে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলাম গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিতে। এরপর সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চলে যাই ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিলাম। ২০১৩ সালে অধ্যাপক হলাম। ২০১৫ সালে অবসরে গেলাম।
এরপর সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পাঁচ মাস কাজ করি। বর্তমানে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেলের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করছি। ২০০১ সাল থেকে ল্যাব এইডে প্র্যাকটিস করছি। আমি এডিনবরা রয়েল কলেজ থেকে সম্মাননা সূচক এফআরসিপি ডিগ্রি লাভ করি।
গান শুনতে ভালোবাসি
আমার দুটো সন্তান। মেয়ে স্নিগ্ধা ধর ( এমবিবিএস পরীক্ষা দিয়েছে।) আর ছেলে ডা. তন্ময় ধর। গান শুনতে আমি খুব পছন্দ করি। সব ধরনের গান শুনি। রবীন্দ্র সংগীত, আধুনিক-সব। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হক, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনের গান শুনি। এ ছাড়া হেমন্ত, লতা মঙ্গেশকর আমার পছন্দের শিল্পী। আমার মোবাইলে অনেক গান রয়েছে। রাতে যখন কাজ করতে থাকি গান চলতে থাকে। রোগীরা শুনে, আমিও শুনি।
রোগীদের ভালোবাসায় প্রেরণা পাই
রোগীদের ভালোবাসি আমি। চেষ্টা করি প্রাণ দিয়ে তাদের দেখতে। একবার অসুস্থ থাকার কারণে চেম্বার কিছুদিন বন্ধ ছিল। তখন অনেক রোগী বলেছেন, ‘আপনার জন্য অনেক দোয়া করেছি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।’ রোগীদের কাছ থেকে এ ধরনের কথাগুলো শুনলে খুব প্রেরণা পাই। ভবিষ্যতেও রোগীদের জন্যই কাজ করতে চাই।
নতুন যাঁরা এই পেশায় আসছেন তাঁদের জন্য বলব- কেবল চিকিৎসক হবেন না। চিকিৎসক ও মানুষ হোন। কারণ, মানুষ হওয়া অনেক কষ্টের।