পরীক্ষা ছাড়াই ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখছেন চিকিৎসক!

কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে যাচাই-বাছাই ছাড়াই চিকিৎসকরা ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রিপশনে (ব্যবস্থাপত্রে) লিখে দিচ্ছেন। অথচ পুষ্টিবিদরা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই চিকিৎসকরা ফুড সাপ্লিমেন্ট ব্যবস্থাপত্রে লিখতে পারবেন না। নিয়মকানুন না মেনে সাপ্লিমেন্ট লিখলে কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে অভিমত দেন পুষ্টিবিদেরা।
যদিও পুষ্টিবিদদের ফুড সাপ্লিমেন্টে নিয়ে করা বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে কিছু চিকিৎসক নিজের যুক্তিতে অনড় থাকতে চান। কোনো কোনো চিকিৎসক অবশ্য বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেশি বা সময় কম বলে দায় এড়াতে ব্যস্ত!
কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে রোগীরা বহির্বিভাগে আসছেন। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে রোগীদের জন্য ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখছেন কোনো ধরনেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়ায়।
যা হওয়ার কথা ছিল
একজন রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসবে, প্রথমে চিকিৎসক চেষ্টা করবেন তাঁকে প্রাকৃতিক খাদ্য দিয়ে শরীরের চাহিদা পূরণ করার। যেমন—পেঁপে, কলা, আঙুর, আপেলসহ পুষ্টিকর বিভিন্ন ফল বা অন্য প্রাকৃতিক খাদ্য দেওয়ার কথা।
এরপরও যখন কোনোভাবেই রোগীর খাদ্যের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয় না, তখন ফুড সাপ্লিমেন্টের কথা চিন্তা করার কথা চিকিৎসকের। তখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার কথা।
যা হচ্ছে
একজন রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগে বা চিকিৎসকের চেম্বারে যাচ্ছেন। চিকিৎসক তাঁকে সর্বোচ্চ দুই মিনিট সময় দিচ্ছেন। কখনো চিকিৎসক নিজে লিখছেন, কখনো আবার চিকিৎসকের সামনে বসে থাকা শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা লিখছেন ব্যবস্থাপত্র। অধিকাংশ প্রেসক্রিপশনে বা ব্যবস্থাপত্রে লেখা হচ্ছে অনুমোদনহীন ফুড সাপ্লিমেন্ট।
এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখার আগে চিকিৎসকরা কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন না। ওই অনুমোদনহীন সাপ্লিমেন্ট কোন ফার্মেসিতে পাওয়া যাবে, সেটাও বলে দিচ্ছেন ওই চিকিৎসক।
কোন পরিস্থিতিতে রোগীকে ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের পুষ্টিবিদ নুসরাত জাহান বলেন, ‘ধরেন একজন রোগী আইসিওতে বা সিসিওতে আছেন। তাঁর হয়তো মাসল বা টিস্যু ব্রেকডাউন হচ্ছে। কোনোভাবেই তাঁকে মুখে খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এরপর নাক নিয়ে সরাসরি পাকস্থলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে খাওয়ানো হয়। তারপরও যদি না হয় তখন আমরা ব্লেন্ডারাইজেশনের মাধ্যমে ডিম বা প্রোটিন দিয়ে থাকি। তখনো যদি দেখি তাঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, তখন আমরা ফুড সাপ্লিমেন্টের দিকে যাই বা চিন্তা করি। তাও সেটা ভেরি রেয়ার। কয়েকদিন পরেই হয়তো আমরা বন্ধ করে দেই। আর যে ফুড সাপ্লিমেন্টগুলো আমরা ব্যবহার করি, সেগুলো পাওডার ফর্মে থাকে।’
ফুড সাপ্লিমেন্টের পরিমাণের ব্যাপারে জানতে চাইলে নুসরাত বলেন, ‘যেসব রোগীর টিস্যু ব্রেকডাউন হয়, যেমন—সেপসিস প্যাশেন্ট, বার্ন প্যাশেন্ট এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত প্যাশেন্টদের প্রোটিন সাপ্লিমেন্টের দরকার হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ৫০-৫৫ গ্রাম বা তাঁর ক্যালরির চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিন দরকার হয়। এর কম বা বেশি যাই থাক, আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়ার চেষ্টা করি।
স্কয়ার হাসপাতালের ওই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘কারোর হাড়ের সমস্যা হলে তাঁর জন্য ভিটামিন ডি বা ক্যালসিয়াম দরকার হয়। এখন ওই রোগীকে ভিটামিন দিতে হলে তা অবশ্যই চিকিৎসক নির্ধারিত হতে হবে। চিকিৎসকই নির্ধারণ করবেন, তাঁর কতটুকু ভিটামিন বা ক্যালসিয়াম দরকার।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ নাজনীন আক্তার বলেন, ‘ডায়েট কন্ট্রোল করার জন্য আমি যে ফুড সাপ্লিমেন্টগুলো দিই তার আগে অবশ্যই হরমোনাল টেস্ট করিয়ে নেই। যেমন টি-৩, টি-৪ বা টিএসএইস এই টেস্টগুলো করিয়ে তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী ফুড সাপ্লিমেন্ট দিই।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ তৃপ্তি চৌধুরী বলেন, ‘রোগীকে ফুড সাপ্লিমেন্ট দিতে হলে অবশ্যই ব্লাড টেস্ট, ওয়েট টেস্ট এবং হাইড টেস্ট করে তারপর ফুড সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। একজন রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলেন আর চিকিৎসক তাকে দুটো ফুড সাপ্লিমেন্ট দিয়ে দিলেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল পন্থা।’
এই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘রোগীর শরীরে খাদ্য বা পুষ্টির ঘাটতি নাও থাকতে পারে। যদি না থাকে সে ক্ষেত্রে ওই রোগীর ওভারডোজ হতে পারে। আর ওভারডোজের কারণে কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এককথায় ওই রোগীর কারেন্ট নিড কী, সেটা জেনে তারপর তাঁকে ফুড সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন আবুবকর সিদ্দিকী। তাঁকে সেখানকার চিকিৎসক ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কোনো পরীক্ষা করা হয়নি। যিনি প্রেসক্রিপশন লিখেছেন, সেই চিকিৎসকের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফুড সাপ্লিমেন্ট দিতে চাইলে রোগীর আরো পাঁচ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। আর পুষ্টিবিদরা যদি এভাবে বলে থাকেন, তাহলে তাঁরাই একা একা ডাক্তারি করুন আর আমরা ডাক্তারি ছেড়ে দিই!’
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বহির্বিভাগের চিকিৎসক রোকসনা আহম্মেদ বলেন, ‘এখানে (বহির্বিভাগে) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেওয়ার সুযোগ কই? তাহলে দিনে তিনজন রোগীর বেশি দেখা সম্ভব হবে না। রোগীর সংখ্যাও অনেক।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে এলেই একজন রোগীর জন্য অনেক সময় আমরা দিতে পারি না। প্রচুর রোগীর ধকল থাকে আমাদের এখানে। সুতরাং কখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব আর কখন তাঁকে প্রেসক্রাইব করব? তবে পরীক্ষা না করেও কখনো বোঝা যায় যে, রোগীর জন্য কত পরিমাণ বা কী দরকার।’
পায়ের গোড়ালির সমস্যা নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন আবদুর রব নামের এক রোগী। চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই ক্যাপসুল ওমেগা-৩ নামে একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করেন।
বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা আসাদুর বলেন, ‘বনবিয়ান ট্যাবলেট নামে একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট দিছেন ডাক্তার। কিন্তু কোনো পরীক্ষা তো করল না।’
ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) শাঈখ আবদুল্লাহ বলেন, আমি আমার সব কলিগকে এসব ডিব্বা কোম্পানির ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করতে নিষেধ করেছি। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেন না চিকিৎসকরা, এটা অবশ্যই ভালো না। এর খারাপ প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তবে এখানে পরীক্ষা করে দেওয়ার সুযোগ খুব কম বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষা করে দেওয়ার নিয়ম অথচ আপনি পরীক্ষা করে দিচ্ছেন না—সেটা কি কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে? বরং মানুষের দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতি হতে পারে। এখানে আসলে চিকিৎসকদের নৈতিকতাটা মুখ্য। চিকিৎসা পেশা একটি মহান পেশা। এটাকে মহান রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।