মহৎ পেশার মানুষ
পুষ্টিবিদ নয়, স্থপতি হতে চেয়েছিলেন তামান্না চৌধুরী

ছোটোবেলায় বেশ শান্ত ছিল মেয়েটি। তাই একবার স্কুলে পড়ার সময় শিক্ষক রিপোর্ট কার্ডে লিখেছিলেন, ‘অতিরিক্ত শান্ত, চটপটে হতে হবে।’ তবে এই শান্ত মেয়েটিই এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউনিসেফ, সেভার বাংলাদেশ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে পুষ্টিবিদ হিসেবে অনুষ্ঠান করেন। যার কথা বলছি তিনি অ্যাপোলো হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী। তিনি লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টারের গত তিন পর্বে ডায়েট ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। গত দুই বছরে ওয়ার্ল্ড হেলথ সারভে সার্টিফিকেট বাংলাদেশে তামান্নাই প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। পুষ্টিবিজ্ঞানকে বাংলাদেশে একটি উঁচু আসন দেওয়ার জন্য, এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। মিষ্টি, অহমিকাহীন মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছে তাঁর পুষ্টিবিদ হয়ে ওঠার গল্প।
মরিচের ড্রামে পড়ে গিয়েছিলাম
আমার বাবা গোলাম মাওলা চৌধুরী সরকারি অফিসার ছিলেন। আমরা তিন বোন ছিলাম। আমি সবার বড়। বাবার বদলির চাকরি ছিল। তাই ছোট বেলায় বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে হয়েছে। তিনি তখন টাঙ্গাইলের মেজিস্ট্রেট ছিলেন। টাঙ্গাইলে থাকার সময় আমাদের বাসায় একটা মরিচের ড্রাম ছিল। মা নিষেধ করেছিলেন সেই ড্রামের কাছে যেতে। তবে ওই যে নিষেধের প্রতি আকর্ষণ, আমি মরিচের ড্রামের কাছে গিয়ে ভেতর পড়ে যাই। পরে সবাই মিলে সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে।
আমি প্রথম শ্রেণীতে উদয়ন স্কুলে ভর্তি হই। এরপর সপ্তম শ্রেণীতে মতিঝিল আইডিয়াল হাইস্কুলে ভর্তি হই। এখান থেকে এসএসসি পাস করেছি। আইএসসি পাস করেছি রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়নে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স এবং মাস্টার্স করি। মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম।
তবে আমার মায়ের শখ ছিল ডাক্তারি পড়ানো। ফরিদপুর মেডিকেলে ওয়েটিং লিস্টে ছিলাম। আমার চিকিৎসক হওয়ার শখ ছিল না। ইচ্ছা ছিল আর্কিটেক্ট হওয়ার। পরে অবশ্য আর পড়া হয়নি। আমার নানু, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (আমার নানুর আপন মামাতো বোন) পরামর্শ দিয়েছিলেন পুষ্টিবিজ্ঞানে পড়তে। তিনি বলেছিলেন, আমাদের সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশে পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে অনেক কাজ করার। তাঁর কথাতেই উৎসাহিত হয়ে এই বিষয়ে পড়া শুরু করি আমি।
পুষ্টিবিজ্ঞানে পড়া চ্যালেঞ্জ ছিল
আমার মনে হতো হোম ইকোনোমিক্স মানে কেবল রান্নাবান্না। এখানে কেবল রান্নাবান্নার বিষয়ই শেখানো হয়। এই ধারণা ভুল ছিল। পড়া শুরু করার পর দেখলাম এটা আসলে একটা মেডিকেলের বিষয়। এতে অনেক ভালো কাজ করার রয়েছে।
মাস্টার্স পাস করার পর দেখলাম পুষ্টিবিজ্ঞানের ওপর কোনো চাকরির সার্কুলেশন পাওয়া যায় না। চাকরি পাওয়া অনেক চ্যালেঞ্জ। হাসপাতালের অনারারি হিসেবেও কাজ করার সুযোগ কম। এরপর ২০০৫ সালে অ্যাপোলো হাসপাতালে সার্কুলার দেওয়া হয়। এখানে পুষ্টিবিদ হিসেবে পরীক্ষা দেই। এখানে চাকরি হওয়ার পর ইন্টারর্নশিপ করতে কলকাতার অ্যাপোলো গ্লিন গেলস হাসপাতালে যাই। সেখানে প্রায় দেড় মাসের মতো ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেই। এই প্রশিক্ষণের সময় বুঝতে পারি পৃথিবীতে পুষ্টিবিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতা অনেক উপরে। এই সম্পূর্ণ সময়টায় এক মাসের মতো মা-বাবা আমার সাথে কলকাতায় ছিলেন। তাঁরা আমাকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নিজের কাছে শপথ করেছিলাম- এই বিষয়ে অনেক কাজ করব। বিষয়টিকে একটি ভালো জায়গায় নিয়ে যাব।
রোগী জিজ্ঞেস করত ডায়েটেশিয়ান আবার কী
প্রথম দিকে যখন রোগী দেখা শুরু করেছি, রোগীরা জিজ্ঞেস করতেন ডায়েটেশিয়ান আবার কী? বোঝাতে অনেক সময় লেগেছে। যে পুষ্টিও চিকিৎসার একটি দিক। যেখানে ওষুধের পাশাপাশি খাদ্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বোঝানো হয়। আর এখন এমনও দিন যায় রোগীরা আমার অ্যাপয়েনমেন্ট পান না। মানুষ এখন খাদ্যে পুষ্টির বিষয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। আমি আজকে যেই অবস্থায় এসেছি, সেজন্য অ্যাপোলো পরিবার অনেক সাহায্য করেছে। তাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ আমি।
তবে এ অবস্থায় আসতে আমার পরিবার অনেক সেক্রিফাইস করেছে। আমি প্রতিবছর বিদেশে যাই। আমার স্বামী সন্তানরা এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করে। অ্যাপোলোতে থাকা অবস্থায় ডায়াবেটিক এডুকেশনের ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছি।
পুষ্টি বিজ্ঞান ভালো জায়গায় পৌঁছেছে
বর্তমানে বাংলাদেশে পুষ্টিবিজ্ঞান একটি ভালো জায়গায় পৌঁছেছে। মানুষ খাবার-দাবারের বিষয়ে অনেক সচেতন হচ্ছে। তারা জানতে চায় কোন খাবারটি ভালো। কোন খাবারটি খেলে শরীরে কী প্রভাব পড়ে।
আমি যেই বিষয়ে লেখাপড়া করেছি সেটাতেই কাজ করতে পারছি। এটা আমার সবচেয়ে বড় সফলতা, আমি মনে করি।
আমার কাছে যেসব রোগী আসে তাদের ৬০ ভাগই নিজে থেকেই পরামর্শের জন্য আসে। এ ছাড়া হাসপাতালের রোগীদের খাবারের পুষ্টির বিষয়টি আমরা তত্ত্বাবধায়ন করি। অনেকে রেফারের মাধ্যমে আসে।
অনেক রোগী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন। রোগীদের ভালোবাসা ও দোয়াতেই এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যেতে চাই।
ক্লিনিক্যাল ডায়েটেশিয়ান হিসেবে বাংলাদেশে অনেক কাজ রয়েছে। একজন ভালো পুষ্টিবিদ তখনই হওয়া সম্ভব যখন সে পাস করার পর ইন্টার্নশিপ করবে।
আমার সফলতা বাবা দেখে যেতে পারেননি
ব্যর্থতা জীবনে নেই। তবে কিছু কষ্ট রয়েছে। আমার সফলতা বাবা দেখে যেতে পারেননি। ২০০৮ সালে বাবা মারা যান। ২০০৮ সালে প্রথম একটা টকশো করি এটিএনে। তখন বাবা বলেছিলেন তোমাকে যদি সবসময় টেলিভিশনে দেখতে পেতাম! এখন টেলিভিশনে অনেক আসি তবে বাবা দেখে যেতে পারেন না। পৃথিবীর বহু জায়গায় কনফারেন্স করতে যাই, বাবা দেখেন না। এটা একটা বড় দুঃখ আমার।
চিকিৎসা জীবন অনেক ঘটনাবহুল হয়। একটা রোগী যখন প্রচণ্ড খারাপ অবস্থা থেকে ভালো হয়ে উঠে তখন ভালো লাগে। একবার একটা ছোট মেয়ে ৯-১০ বছরের, সে অ্যাপোলো হাসপাতালে ছয় মাসের বেশি ভর্তি ছিল। যখন সে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল খুব ভালো লেগেছিল। মুমূর্ষু অবস্থার রোগী সুস্থ হয়ে যায় তখন ভালো লাগে।
বর্তমানে বাঁচি
আমি সবসময় রুটিন মেনে চলি। সময়ের কাজ সময়ে করার চেষ্টা করি। আমার প্রত্যেকটি কাজের রুটিন রয়েছে। অফিস যে সময়েই থাকুক না কেন দ্রুত পৌঁছানোর চেষ্টা করি। কাজ আগে থেকেই গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আমি অতীত বা ভবিষৎ নিয়ে ভাবি না। বর্তমান নিয়েই বাঁচি, বর্তমান ভালো করার চিন্তা করি।
তবে আমি নেতিবাচক বিষয় আগে ভাবি। ইতিবাচক দিক হলে খুশি হই। তবে নেতিবাচক হলে খুব বেশি আহত হই না।
বর্তমানে নিয়মিত এসএ টেলিভিশনে আমাদের রান্নাঘর অনুষ্ঠানে কাজ করছি। গাজী টেলিভিশনে আহমেদ ফুড রান্নাঘর অনুষ্ঠান করছি। আরটিভিতে ট্রিকস রান্নাঘর অনুষ্ঠানের পুষ্টিবিজ্ঞানের অংশটি করি। এনটিভিতে বিভিন্ন রান্না-পুষ্টি বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখি করি।
কাজ করতে পরিবারের সহযোগিতা প্রয়োজন
বাবা-মায়ের মধ্যে বড় হয়েছি- এটা অনেক বড় সুখ। আমি সবসময় হাসি। আমার কাজের জন্য আমার পরিবারকে অনেক ত্যাগ করতে হয়। আমি আমার স্বামী ও সন্তানদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে কাজ করার জন্য অনেক সহোযোগিতা করে। পরিবার থেকে সম্পূর্ণ সাহায্য না পেলে একজন মেয়ের জন্য কাজ করা ভীষণ কঠিন।
বাংলাদেশে থেরাপিউটিক নিউট্রিশন সেন্টার হলে আমার খুব ভালো হতো। আমার নিজের করার ইচ্ছা রয়েছে। যদি কেউ এগিয়ে আসেন তাদের সাথেও আমি কাজ করতে চাই। ডায়েটেশিয়ান পেশা সেবার অন্যতম উদাহরণ। কেউ যেন ব্যবসায়িক প্রলোভনে এটা না ব্যবহার করে। এই প্রফেশনে যারা আসতে চায় তাদের বলব, তারা যেন অবশ্যই ইন্টার্নশিপ করে আসে। কারণ পুথিগত বিদ্যাকে মানব শরীরে প্রয়োগ করার আগে ইন্টার্নশিপ করা এবং রোগীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা অবশ্যই প্রয়োজন।