মহৎ পেশার মানুষ
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো : ড. অরূপ রতন

১৯৭১ সালের জুন মাস, মুক্তিযুদ্ধ চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনে উদ্বুদ্ধ হলো ১৮ বছরের একটি কিশোর। সিদ্ধান্ত নিল, যুদ্ধে যাবে; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান করবে।
কোনো এক ভোররাত। ছেলেটি ঘুম থেকে উঠল। খাটে মশারি টাঙানো। পরনের কাপড়েই বেরিয়ে গেল সে, ঘরের কাউকে কিছু না বলে। ঘরে অসুস্থ মা, পাছে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাই চুপি চুপি ঘর থেকে পালায় ছেলেটি। কোনো দলের সঙ্গে নয়, একা বেরিয়ে গেল যুদ্ধ করতে।
নীলক্ষেত থেকে ইপিআরটিসি বাসে উঠল সেই তরুণ। কাঁচপুর, দাউদকান্দি হয়ে কুমিল্লা পৌঁছাল সে। দাউদকান্দিতে গিয়ে দেখল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্রাশ ফায়ার করছে চোখ বেঁধে। ছেলেটি দৈবক্রমে বেঁচে গেল। এরপর গ্রামবাসীর সহযোগিতায় পার হলো বর্ডার। আগরতলা কলেজটিলায় গণসংগীতের দল করা হয়েছে। সেখানে এক মাস থাকল। কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য গান শোনানো। এরপর আগরতলা থেকে কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যায় সে। সেখানে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান শুরু করল তরুণ।
যার কথা বলছি, তিনি কেবল মাত্র একজন কণ্ঠযোদ্ধা ও সংগীতশিল্পীই নন, তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রথিতযশা চিকিৎসক অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী। বর্তমানে তিনি বারডেম হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া যুবসমাজকে মাদকমুক্ত করতে ৩৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পী এবং উপস্থাপক। এই বহুগুণে গুণান্বিত মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন তার ঘটনাবহুল জীবনের কথা।
ডাক্তার হওয়ার গল্প
১৯৫২ সালে সিলেটের এক জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করি আমি। আমার মা বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী। বাবা সিলেটের কৃতী সন্তান শৈলেন্দ্র কুমার চৌধুরী। আমরা তিন ভাইবোন। বড় ভাই অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী, বোন অধ্যাপক ড. মধুশ্রী ভদ্র।
বাবা-মায়ের শখ ছিল আমাকে চিকিৎসক বানাবেন। তখন তো এখনকার মতো সময় ছিল না। আমরা বাবা-মায়ের কথা শুনতাম। বাবা-মায়ের কথামতো চলতাম। বাবা-মায়ের ইচ্ছা সন্তানদের ওপর প্রতিফলিত হতো। তবে বাবা-মায়ের কথা শোনায় ভালোই হয়েছে। আজ চিকিৎসক হতে পেরেছি। মানুষকে সেবা দিতে পারছি।
১৯৭০ সালে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হই। তখন মানুষ দাঁত নিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি ভালোভাবে বুঝত না। তবে আমি তখনই দাঁত নিয়ে পড়তে আগ্রহী হই।
১৯৭৬ সালে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে বিডিএস করি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দন্ত্য চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলোশিপ নিই। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক এট স্ট্রনিব্রোক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দন্ত্য চিকিৎসায় ফেলোশিপ লাভ করি। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি অর্জন করি।
২০১২ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব সার্জনস থেকে ফেলোশিপ ইন ডেন্টাল সার্জারি ডিগ্রি লাভ করি।
দীর্ঘ ৩৮ বছর এ দেশের দন্ত্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে বহু প্রকাশনা ও গবেষণা করেছি। এ দেশের জনগণের কাছে দন্ত্য চিকিৎসার বিভিন্ন তথ্য ও রোগ প্রতিরোধের ওপর বেতার-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান নির্মাণ ও উপস্থাপনার মাধ্যমে কাজ করেছি।
১৯৮৯ সালে মাদক ও ধূমপানবিরোধী সংগঠন ‘মানস’ প্রতিষ্ঠা করি এবং এ সংগঠনের মাধ্যমে দেশের যুব সম্প্রদায়কে ধূমপান ও মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি।
ধূমপান ও মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মেডেল লাভ করি এবং ২০০১ সালে আমেরিকা বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউটের সদস্য পদ লাভ করেছি। এরই মধ্যে ৩৮টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি, বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ উপস্থাপন করেছি সেসব জায়গায়।
কলাগাছ কেটে সাঁতার শিখেছি
সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ভেতর একটি শিশু স্কুল ছিল। ছোটবেলায় আমি সেখানে পড়তাম। মেয়েরা ছিল আমার বন্ধু। ওই সময়টা খুব ভালো ছিল। কলাগাছ কেটে সাঁতার শিখেছি। একসঙ্গে অনেকে মিলে তখন সাঁতার কাটতাম। আমাদের খুব নিয়ম মেনে চলতে হতো। সময়মতো খেলাধুলা করা, স্কুলে যাওয়া, খুব নিয়মানুবর্তী জীবন কাটাতাম।
এখনো আমার মধ্যে নিয়মানুবর্তী থাকার অভ্যাস রয়ে গেছে। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে যাই, পূজা করি। এরপর অফিস করি, চেম্বার করি। খুব নিয়মমাফিক জীবন-যাপন করি।
আমি অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে লেখাপড়া করি। মা তখন সিলেট থেকে বদলি হয়ে যান। তখন ময়মনসিংহে হোস্টেলে থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিই। সেই সময় থেকে নিজের ওপর নির্ভর করতে শিখেছি। মেট্রিক পরীক্ষা ছাত্রজীবনের একটি বড় পরীক্ষা। সেটা দিয়েছি বাবা-মা ছাড়াই। এটা আমাকে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে শিখিয়েছে। তখন বুঝে গিয়েছিলাম আমার নিজেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
এরপর মা ঢাকায় চলে আসেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। তখন জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি।
জগন্নাথ কলেজে এসে আরেকবার অভিজ্ঞতা হলো। পুরান ঢাকা, এর সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অবস্থা, সবই নতুন। এসবের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।
মাঝখানে একবার মা সিলেট থেকে ঢাকায় বদলি হন। তখন নবকুমার স্কুলে ভর্তি হই। উর্দু রোডে থাকি। আবার ময়মনসিংহে ভর্তি হয়ে যাই। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। তখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই।
সিলেটের বাসায় আমাদের গানের শিক্ষক আসতেন। সুরসাগর প্রাণেশ দাস আমাদের শিক্ষক ছিলেন। আমার মা নিজেও গান-বাজনা করতেন। প্রতিদিন আমাদের বাসায় রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা হতো। ঢাকায় আসার পর জগন্নাথ কলেজে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে যাই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের চারতলায় ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ছিল। ডাকসুর সাংস্কৃতিক কাজগুলো করতাম। কাদের কিবরিয়া, রথীন রায়, ফকির আলমগীর- আমরা সবাই মিলে গান গাইতাম। ডাকসুর সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে সে সময় আমি জড়িত ছিলাম।
তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং ডেন্টাল কলেজ একই ছাত্র সংগঠনের আওতাধীন ছিল। সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম; অভিনয়ও করতাম।
আমার যুদ্ধ
’৭১ থেকে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকায় বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হই। তখন আমরা রাস্তায় রাস্তায় গান করি। সমস্ত সাংস্কৃতিক অন্দোলনের সঙ্গে তখন আমি জড়িত ছিলাম।
জুন মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেলাম। আগরতলা থেকে সরদার আলাউদ্দিনের (বিশিষ্ট লোকসংগীতশিল্পী) সঙ্গে ট্রেনে চড়লাম কলকাতার উদ্দেশে। ট্রেনে ছিলাম চারদিন, চাররাত। ট্রেনের টিকেট লাগত না সেই সময়। বলা হতো, ‘জয় বাংলা এসেছে’। এরপর কলকাতায় পৌঁছালাম। সেখান থেকে মরহুম আবদুল মান্নান (পরবর্তীকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী) পাঠালেন ৫৭/এ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেটিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিস। সেখানে সমর দাস, সুজয় সেন, এম আর আক্তার মুকুল, শহীদুল ইসলাম- এ রকম বড় বড় লোকদের সঙ্গে দেখা হলো। আমরা কয়েকজন শিল্পী মিলে জুন মাস থেকে সেখানে থাকা শুরু করি। এই সময় পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, নোঙর তোলো তোলো, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ইত্যাদি গান গাওয়া হতো দল বেঁধে। যতগুলো রেকর্ড করা গান রয়েছে সবগুলোতেই আমার কণ্ঠ রয়েছে। কলকাতার প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে তখন আমরা গান গাইতাম।
এরপর যুদ্ধ শেষ হলো। দেশে ফিরে আমি প্রথম বর্ষে ভর্তি হলাম। ডাক্তার হওয়ার পর চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করি। গত ৩৫ বছর ধরে আমি ধূমপানের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছি। রোগীর কাছ থেকে কেবল মাত্র টাকা পেলাম, সেটিই চিকিৎসা নয়। মানুষকে ভালো রাখাও দায়িত্ব।
বারডেমে আসা
বারডেম হাসপাতালে আমি প্রায় ২৮ বছর ধরে কাজ করছি। পিজি হাসপাতালে কাজ করতাম ১৯৮৬ সালে। ডা. মো. ইব্রাহিম একবার পিজিতে দাঁতের চিকিৎসা করাতে যান। কোনো কারণে হয়তো আমাকে তাঁর ভালো লেগে গিয়েছিল। উনি আমার দাঁতের চিকিৎসা পেয়ে মুগ্ধ হলেন। এরপর উনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ফোন করলেন। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ আবদুল মতিন। ইব্রাহিম সাহেব তাঁকে বললেন, ‘এই ছেলেকে বারডেমে দাও।’ ২৮ ঘণ্টায় সরকারিভাবে অর্ডার হলো আমাকে বারডেমে পাঠানোর। আমাকে সপ্তাহে দুদিন বারডেমে কাজ করতে বলা হলো। তখন সেখানে ডেন্টাল চেম্বার ছিল না। পরের বছর রোগী বাড়তে শুরু করল। আবার মন্ত্রণালয়ের চিঠি এলো এখানে পূর্ণকাল কাজ করার জন্য। ইব্রাহিম সাহেব অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোক ছিলেন। ডায়াবেটিস রোগীদের যে দাঁতের সমস্যা হতে পারে এবং এটি যে একটি বড় বিষয়, তিনি বহু আগেই সেটি বুঝতে পেরেছিলেন।
আমার গান
বুলবুল ললিতকলা একাডেমিকে আতিকুল রহমানের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি। আমি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের এনলিস্টেড শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের গান গাই আমি। বেতার ও টেলিভিশনে একজন সফল স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপক। এরই মধ্যে চারটি অডিও সিডি ও একটি ভিসিডি বের হয়েছে আমার।
এ ছাড়া বর্তমানে মাদকের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ‘স্বর্গ থেকে নরক’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। সেটি সারা দেশে মুক্তিও পেয়েছে।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো
আমার জীবনের প্রতি প্রতিজ্ঞা সাংঘাতিক। ১৮ বছর বয়সে আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। একা যুদ্ধে গিয়েছিলাম, দলের সঙ্গে যাইনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং আচরণ রাখি। জয় করার ইচ্ছা আমার অদম্য।
জীবনের বিভিন্ন জায়গায় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমাকে নিন্দা করা হয়েছে। আমার সমালোচনা, আমার বাধা, আমাকে প্রেরণা জোগায়। আমি থেমে যাই না, কাজ করে যাই। আমি খুব জেদি স্বভাবের। একটি কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পেছনে লেগেই থাকি।
আমার জীবনের আদর্শ মা মঞ্জুশ্রী চৌধুরী। তিনি একজন প্রকৃত মা। আমার মা সংসার করেছেন, চাকরি করেছেন, আবার লেখাপড়াও করেছেন। আমার স্ত্রী গৌরী চৌধুরী। দুই ছেলে অনির্বাণ চৌধুরী ও সপ্তক চৌধুরী।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
যদি কেউ সেবার হাত বাড়িয়ে দেয়, রোগীকে সম্মান করে তাকে সবাই সম্মান দেয়। চিকিৎসকরা যদি চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক কাজগুলো করত, অনেক ভালো হতো। আমার দর্শন মানবসেবা। জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এটাই আমার দর্শন।
এ দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র করতে চাই। আমরা কেবল চিকিৎসাই করি। এখনো রোগ প্রতিরোধ করতে পারিনি।