মহৎ পেশার মানুষ
নিজেকে উত্তম কুমার মনে হতো : ডা. সামন্ত লাল সেন

২০১০ সালের ৩ জুন, বৃহস্পতিবার। রাতের খাবার খেতে বসেছেন একজন চিকিৎসক। হঠাৎই ফোন বেজে উঠল। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। ফোনের ওই পাশের কণ্ঠস্বর জানাল, হাসপাতালে প্রচুর পোড়া রোগী আসছে। এক ভয়াবহ অবস্থা। হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। চিকিৎসক যেন এখনই চলে আসেন।
খবর পেয়ে না খেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন সেই চিকিৎসক। নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলেন হাসপাতালে। গিয়ে যেই কাণ্ড দেখলেন তা শিউরে ওঠার মতো। পুড়ে যাওয়া রোগীদের লাশ আর লাশ। পোড়া রোগী আসছে প্রচুর। আত্মীয়স্বজনের চিৎকার আর আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস তখন ভারী হয়ে উঠেছে।
কেমিক্যালের গুদাম থেকে আগুন লেগেছিল পুরান ঢাকার নিমতলীতে। এত পোড়া রোগী আর কখনো দেখননি তিনি। স্তব্ধ হয়ে গেলেন চিকিৎসক। কীভাবে সামলাবেন এদের? ওপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করলেন যেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। পোড়া রোগীদের যেন চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন।
যেই চিকিৎসকের কথা বলছি, তিনি দেশের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জাতীয় প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন। ২০১০ সালের পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর শতাধিক পোড়া রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনি এবং তাঁর ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের দল।
সারা জীবন চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত, সুহৃদ ও রসিক এই মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প।
ডাক্তার হলাম কেন?
সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার নাগুরা গ্রামে ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর আমার জন্ম। সেটা ছিল খুব প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। বাবা জিতেন্দ্র লাল সেন সরকারি চাকরি করতেন। পাঁচ ভাইবোন আমরা।
বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর ছেলে চিকিৎসক হবে। আর আমিও ছোটবেলায় ডাক্তার সেজে কলাগাছে ইনজেকশন দিতাম। সেই সময় কেবল এমবিবিএস পাস চিকিৎসক ছিল। একজন চিকিৎসক ছিলেন আমাদের ওখানে। নাম ধীরেন চক্রবর্তী। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হতাম। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছাটা তখন থেকেই।
ফড়িংকে মরিচ মনে করে খেয়ে ফেলেছিলাম
আমি ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতাম। একবার ফুটবল খেলতে খেলতে পড়ে গিয়েছি। দেখি, সামনে মহিষ দাঁড়িয়ে আছে। যে ভয়টাই না পেয়েছিলাম!
সবুজ রঙের একধরনের ফড়িং ছিল। রাতের বেলা বাবা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসাতেন। মরিচ মনে করে একদিন ফড়িং খেয়ে ফেলেছিলাম।
আমি নাগুরা ফার্ম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের লেখাপড়া শেষ করি। বাবা যেহেতু সরকারি চাকুরে ছিলেন, তাই তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি।
মেট্রিকুলেশন পাস করেছি সেন্ট ফিলিস হাইস্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে।
এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হই। ৭২-৭৩ সালে পাস করে বের হই। আমি ভিয়েনা থেকে ১৯৮০ সালে প্লাস্টিক সার্জারিতে ডিপ্লোমা করেছি। পরে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নিই।
নিজেকে উত্তম কুমার মনে হতো
ডাক্তারি পাস করার পর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে প্রথম কাজ শুরু করি। সেখানে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। কোনো রকম যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। সাইকেল চালিয়ে, নৌকায় চড়ে যেতে হতো। তখন তো মাত্র পাস করেছি, লম্বা চওড়া, সুন্দর দেখতে ছিলাম। নিজেকে তখন উত্তম কুমার মনে হতো।
আমার কাছে তখন অনেক অভিভাবক মেয়ে বিয়ে দিতে চাইত। রোগী দেখতে গেলে কাঁসার থালায় অনেক রকম খাবার দিত আর তার পাশে টাকা দিত। একদম জামাই আদর যাকে বলে!
এরপর ঢাকায় বদলি হয়ে আসি। তখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ শুরু করি। ইমার্জেন্সিতে কাজ করি। ১৯৭১ সালের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডা. গাস্টকে এ দেশে নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়ার জন্য।
১৯৭৫ সালে ডা. গাস্ট ভারতের প্লাস্টিক সার্জন ডা. বেজলিলকে নিয়ে আসেন এ দেশে কাজ করতে। এরপর ডা. গাস্ট আমায় বললেন, ‘তুমি প্লাস্টিক সার্জারিতে কাজ করো।’ এরপর আমার প্লাস্টিক সার্জারির লেখাপড়া শুরু হলো।
তখন স্বপ্ন দেখতাম প্লাস্টিক সার্জারি করে মানুষের চেহারা সুন্দর করব। আর অনেক টাকা রোজগার করব।
পরে ১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে এলাম। তখন আমার বস ছিলেন অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্লাস্টিক সার্জন। তিনি আর নেই। তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলাম। তাঁরা তখন আমাকে চাপ দিলেন পোড়া রোগীদের জন্য কোনো কাজ করতে।
পোড়া রোগীদের খুব কাতর অবস্থা দেখতাম। তারা মাটিতে পরে থাকত, পথে পড়ে থাকত। এদের দেখে আমি চিন্তা করলাম এ দেশে মানুষের চেহারা সুন্দর করার চেয়ে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা করা বেশি জরুরি। আমার মানসিকতার পরিবর্তন হলো। এরপর তাদের নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করে দিলাম।
আমার একটি মেয়ে, একটি ছেলে। মেয়ের একবার মুখে মিজেলস হলো। সে বলল, বাবা এগুলো ঠিক করার জন্য চিকিৎসা তুমি করে দাও। তখন তাকে পোড়া রোগী দেখালাম। সে দেখল এবং আমার কাজের বিষয়টি বুঝল। আমি তাকে বোঝালাম আমার কাজ এখন এই মানুষদের নিয়ে। সেও আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে।
ব্যর্থতা
দেশের পোড়া রোগীদের সাহায্যের জন্য, হাসপাতাল করার জন্য যখন মন্ত্রণালয়ে ঘুরেছি, তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগত। ফাইল ছুড়ে দিত। তবে আজ আমি সফল।
১৯৮৬ সালে পোড়া রোগীদের জন্য সরকারের কাছে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ তৈরি করার প্রস্তাব দিই। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে বার্ন ইউনিট তৈরির কাজ চলে। ২০০৩ সালে ইউনিটটি উদ্বোধন হলো। আমি ইউনিট তৈরি করতে পেরেছি। পাঁচটি বেড নিয়ে ইউনিট চালু করেছিলাম। আর এখন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউট তৈরি করার বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি।
মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কী হতে পারে?
একবার সিএনজিতে উঠেছি। নামার পর ড্রাইভার আর টাকা নিতে চাইছিল না। বলল, ‘স্যার আপনি অনেক সিএনজিচালকের উপকার করেছেন। আহত অবস্থায় তাদের বাঁচিয়েছেন। আপনার কাছ থেকে টাকা নেব না।’
আমরা গ্রামগঞ্জে গিয়ে ঠোঁট কাটা, তালু কাটা রোগীর চিকিৎসা দিতাম। একবার এক গ্রামে গিয়েছি। একজন মেয়ে ও একজন ছেলে এসে আমার পায়ে ধরে সালাম করল। আমি তো অবাক! হঠাৎ করে পায়ে ধরে সালাম করছে! পরে মেয়েটি জানাল, আমরা তার চিকিৎসা করেছিলাম। এখন সে ভালো আছে। এবং তার বিয়ে হয়েছে। এই বিষয়গুলো সত্যি অনেক আবেগতাড়িত করে।
সাধারণ মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। দোকানি, হোটেলমালিকরা দেখলে দৌড়ে আসে। এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া।
এটা হয়তো হয়েছে আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদের কারণে। তাঁদের ছবি সব সময় আমি পকেটে রাখি। তাঁরা আমার জন্য না করলে হয়তো এতদূর আসতাম না। পড়ালেখায় যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেই চেষ্টা করেছেন সব সময়।
চিকিৎসক হওয়া মানে আসলে ওপরওয়ালার আশীর্বাদ পাওয়া। তারা টাকা উপার্জনও করতে পারে। আবার মানুষের ভালোবাসাও পেতে পারে।
ভালো লাগে উত্তম-সুচিত্রার ছবি
উত্তম-সুচিত্রার ছবি আমার খুব ভালো লাগে। আর পুরোনো দিনের গান শুনতে ভালোবাসি। মাঝে মাঝে মজা করে বলতাম, বাঙালির মধ্যে আছে শুধু তিন সেন। সুচিত্রা সেন, অমর্ত্য সেন আর আমি সামন্ত সেন। হা হা হা..
বিনা চিকিৎসায় যেন রোগী মারা না যায়- আশা এটাই
বাংলাদেশের কোনো পোড়া রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় না মারা যায় এটিই আমার আশা, স্বপ্ন। এ জন্য বার্ন ইউনিটকে ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ছয় লাখ মানুষ আগুনে পোড়ে। আর এদের জন্য ডাক্তার মাত্র ৫২ জন। অন্তত ১৫০০ চিকিৎসক প্রয়োজন দেশের পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য। বর্তমানে আমার ধ্যান জ্ঞান সব ইনস্টিটিউট নিয়ে। কীভাবে একে ভালোভাবে দাঁড় করব এটাই আমার চিন্তা। রাত-দিন এটা নিয়ে আছি। প্রাইভেট প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে দিয়েছি এর জন্য। তবে মানুষ যেন না পোড়ে সেই বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
নাতনির সঙ্গে খুনসুটি করি অনেক
আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে নবনীতা সেন। ছেলে অনাবিল সেন। স্ত্রী রত্না সেন। আগে চাকরি করতেন। এখন করেন না। এক নাতনি আছে আমার। তার সঙ্গে খুনসুটি করি অবসরে।
আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। মানুষের ভালোবাসাই আমার পরম পাওয়া। দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
ভালো চিকিৎসক হলে টাকা দৌড়ে আসবে
নতুন যাঁরা এই পেশায় আসছেন, তাঁদের জন্য বলব, দেশকে ভালোবাসুন আর মানুষকে ভালোবাসুন। নিজের আত্মীয়স্বজনদের যেই যত্ন নিয়ে চিকিৎসা করতেন, রোগীরদের বেলাতেও সেটি ভাবুন। ভাবুন এরা আপনার মা, বোন।
আসলে টাকার পেছনে দৌড়াতে হয় না, ভালো চিকিৎসক হলে টাকা আপনার পেছনেই দৌড়ে চলে আসবে।