মহৎ পেশার মানুষ
মনের যত্ন নিতে হবে : ডা. হেলাল

জন্ম তাঁর ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের পৈতৃক বাড়িতে। অনেক বড় জায়গায় গাছগাছালিতে ভরা এই বাড়িতে আট ভাইবোনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা তাঁর। মা-বাবা কেউই খুব খবরদারি করতেন না তাঁদের ওপর। সব ব্যাপারেই একটা স্বাধীনতা নিয়ে বেড়ে ওঠা তাই।
যার কথা বলছি, তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড এডোলোসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। ছাত্র পড়ানো, লেখালেখি, গবেষণা আর অটিজম নিয়েই বর্তমান কাজ তাঁর। এনটিভি অনলাইনকে তিনি জানিয়েছেন তাঁর মানসিক রোগের চিকিৎসক হয়ে ওঠার গল্প।
এই পেশায় আসব শুরুতে এমন ভাবিনি
শুরু থেকে কোনো পরিকল্পনা ছিল না এই পেশায় আসার। শুরু থেকে টার্গেট ছিল সাংবাদিক হব। স্কুল থেকে সাংবাদিক নামে উপমা দিত। হা হা হা...। পরে যখন এসএসসি পাস করলাম, তখন ফলাফল ভালো হয়ে গেল। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে ১৯৮৯ সালে এসএসসি পাস করি। পাস করার পর ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। এইচএসসি পাস করি ১৯৯১ সালে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাই।
মেডিকেলে কলেজের জীবন ছিল ভীষণ বর্ণিল। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম করতাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচন করেছিলাম। সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিতও হয়ে গেলাম। ইন্টার্নি ডকটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলাম। যখন ইন্টার্ন করতাম ভেবেছিলাম প্লাস্টিক সার্জন হব। তবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
ইন্টার্ন শেষে ঢাকায় এসে নিউরোমেডিসিনের ওপর অবৈতনিক প্রশিক্ষণ শুরু করলাম। এর পর বারডেম হাসপাতালের নিউরোমেডিসিন বিভাগে চাকরি পেয়ে গেলাম ১৯৯৯ সালে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে মেডিসিনের অধ্যাপক ছিলেন এম এ ফয়েজ। সর্প দংশন আর ম্যালেরিয়া নিয়ে তাঁর বিশ্বজয়ী গবেষণা রয়েছে। তাঁর অনুপ্রেরণায় নিউরোমেডিসিনে কাজ শুরু।
বারডেমে রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে ‘পাবলিক ডিলিং’ করতে হতো। পাবলিক রিলেশনের কাজটি খুব ভালোভাবে করতে পারতাম। তখন মনে হতো মানুষকে বুঝতে পারি। এই সময়ই ভাবলাম মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করলে কেমন হয়। আমি তো এখানেও কাজ করতে পারি। এরপর বিসিএস দিলাম। বারডেমের চাকরি ছেড়ে দিলাম।
বিসিএস হওয়ার পর টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে চাকরি হলো। সে সময় দেখলাম কীভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। তখন আমি অনেক কিছু শিখলাম।
টাঙ্গাইলে থাকার সময় সাইকিয়াট্রিতে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তির জন্য পড়াশোনা শুরু করলাম। একসময় ঢাকায় আসতে চাইলাম। আসতে পারলাম না। বদলি হয়ে গেলাম মুন্সীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম চর ডুমুরিয়ায়। তাঁর কিছুদিন পর আবার মুন্সীগঞ্জ শহরে চলে এলাম। একই সময় ঢাকায় এসে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম সাইকিয়াট্রিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম এমডি কোর্সে। এখানে পড়া শুরু করলাম। দুই বছর পর এই বিষয়ে পড়ার প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর ২০০৭ সালে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দিলাম। এখানে সরাসরি মানসিক রোগীদের সংস্পর্শে এলাম। তবে এমডি কোর্সের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার জন্য আরো তিন বছরের প্রশিক্ষণ লাগবে। এরপর ২০০৯ সালে চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য বিএসএমএমইউতে চলে গেলাম। এই সময়ে আমার অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক কামাল উদ্দিন স্যার। স্যার ২০১১ সালে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। স্যারের আদর্শ আর মেধা আমাকে সব সময় আকৃষ্ট করত। ২০১১ সালে পাস করে আবার মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চলে এলাম। ২০১৩ সালে সহকারী অধ্যাপক হলাম।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে থাকার সময় সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক ছিলেন শাহ আলম স্যার। তিনি মানসিক রোগীদের ওয়ার্ডে গান বাজাতেন। দেখতাম ওই ওয়ার্ডটা অন্যান্য ওয়ার্ড থেকে একটু ভিন্ন। হয়তো আমার এ পেশায় আসার পেছনে ওনার প্রচ্ছন্ন একটা প্রভাব ছিল।
এ ছাড়া স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ার সময় অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, অধ্যাপক ওয়াজিউল আলম চৌধুরী, অধ্যাপক এম এস আই মল্লিক, অধ্যাপক ঝুনু শামসুন নাহার, অধ্যাপক এম এ হামিদ, অধ্যাপক মোহিত কামাল, অধ্যাপক ফারুক আলম, অধ্যাপক তাজুল ইসলাম স্যারসহ অসংখ্য শিক্ষকদের কাছে আমি অপরিসীম অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসা পেয়েছি এবং এখনো তাঁদের আশীর্বাদ পেয়ে যাচ্ছি। আমার শিক্ষকদের এই ভালোবাসা আমার সবচেয়ে পরম পাওয়া।
মনের যত্ন নিতে হবে
মানসিক রোগীদের নিয়ে বিভিন্ন রকম স্টিগমা আমাদের দেশে এখনো প্রচলিত। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কিছু জিনিস সুস্পষ্ট করে বলতে হবে। মন তো মানুষেরই শরীরের অংশ। কিন্তু এর যত্নের জন্য আমরা কী করি? মনের যত্নের বিষয়ে আমরা খুবই উদাসীন। শরীরের অন্যতম অনুষঙ্গ মন। বলা হয়, ‘নো হেলথ উইদাউট নো মেন্টাল হেলথ’। মানসিক রোগ হলে একজন মানুষ কর্মক্ষমতা হারায়। এতে ব্যক্তির, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। ভাবলে দেখবেন, এতে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থের অপচয় হচ্ছে। তাই মানসিক রোগের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। আবার শিশুদের মধ্যেও মানসিক বৈকল্য আসতে পারে। তাদের ভালো রাখতে পরিবার থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠেছি
ছেলেবেলায় দেখতাম, মা রান্নায় খুব ব্যস্ত থাকতেন। বাবা-মা কেউই আমাদের ওপর কোনো খবরদারি করতেন না। নেতিবাচক আচরণ করতেন না। খবরদারি হতো না বলেই হয়তো খারাপ কিছুর প্রতি আগ্রহ হয়নি। স্বাধীন ছিলাম। আমার বাবার নাম জাইনুদ্দিন আহমেদ। তিনি ঢাকা সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। আমার মা আশরাফুন্নেসা এ বছর মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার জীবনে আমার মা-বাবার প্রভাব অনেক বেশি।
আমাদের বাড়িতে একটি বড় কূপ ছিল। নিরাপত্তার কারণে ঢেকে রাখা হতো সেটি। নিচের দিকে তাকালে ভয় লাগত। আমরা ছিলাম নয় ভাইবোন। বড় ভাই জামাল আহমেদ (বর্তমানে চারুকলার শিক্ষক) আমাদের চায়নিজ খাওয়াতে নিয়ে যেতেন। ঢাকায় তখন খুব কম চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। এটি ছিল খুব আনন্দের। আমার অন্য ভাইবোনরা বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড় হওয়ায় তাঁদের কাছ থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা আর স্নেহ পেয়েছি।
দ্রুত ছুটতে হবে এমন ভাবিনি
আসলে খুব দ্রুত ছুটতে হবে- এমন ভাবনা আমার মধ্যে ছিল না। কচ্ছপের মতো এগিয়েছি। দৌড়ে, ছুটে যেতে হবে- কখনো এমন মনে হয়নি। আমার উপলব্ধি, তাড়াহুড়া করে কোনো লাভ নেই। ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে চলতে হবে। সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই কাজটি বেশ কঠিন। আমি আসলে খুব যে বুঝে অপেক্ষা করেছি বিষয়টি সেটি নয়। তবে পরে বুঝেছি অপেক্ষা করে ভালো করেছি।
পেশাগত জীবনে কিছু ব্যর্থতা আছে। মানসিক রোগীদের যেভাবে দেখতে চাই, সাইকিয়াট্রি বিষয়টিকে যেভাবে দেখতে চাই, সেভাবে দেখতে পারিনি। বাস্তবতা তার থেকে আলাদা। আমাদের আরো কাজ করতে হবে এ বিষয়ে ওপর। আসলে সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র সব কিছুকে আরো সচেষ্ট হতে হবে বিষয়টি নিয়ে।
পরিবারকে সময় দিতে পারি না
আমার স্ত্রী ডা. তানজিনা হোসেন চিকিৎসক; সহকারী অধ্যাপক (এন্ডোক্রাইনোলজি)। তিনি বর্তমানে কাজ করছেন গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজে। পাশাপাশি তিনি গল্পও লেখেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। আমার দুজন সন্তান। ছেলে যুহায়ের পড়ছে সেন্ট যোসেফ স্কুলে, ক্লাস সেভেন। আর মেয়ে যুনাইরা পড়ছে ক্লাস টু গ্রীন হেরাল্ড স্কুলে।
কাজের ব্যস্ততার কারণে পরিবারকে সময় দিতে পারি না। পেশাগত জীবন ঠিক রাখতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য তাদের কাছে খুব অপরাধী লাগে। তবে তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ আমাকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য।
রোগী সুস্থ হয়ে উঠছে দেখলে ভালো লাগে
আমার কাছে একটি শিশু আসত, এখনো আসে, তার সাইকোসিস রোগ। কয়েক বছর থেকে সে আমার কাছে আসত। ছেলেটি এই রোগের মধ্যেও এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছে। এটা আমার কাছে অনেক পাওয়া মনে হয়।
আমি অটিজম নিয়ে কাজ করি। তাদের চিকিৎসা করার পর বাচ্চাটা যখন একটু ভালো থাকে, তখন ভালো লাগে। দিশেহারা বাবা-মা যখন একসময় এসে বলেন, এখন আমার শিশুটি ভালো আছে- একে বড় পাওয়া মনে হয়।
বর্তমান কাজ
আমি স্নাতকোত্তর পড়াই। এ ছাড়া বেশ কিছু গবেষণার কাজ করছি বর্তমানে। ডায়াবেটিস ও ডিপ্রেশন নিয়ে ১৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তদেশীয় একটি গবেষণা হচ্ছে- এতে গবেষক হিসেবে কাজ করছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে লেখালেখি করছি। এ ধরনের লেখার সংখ্যা ২০০-এর বেশি। আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় জার্নালে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ৪০টির বেশি। প্রায় ১৮টি দেশে আমি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ ও পোস্টার উপস্থাপন করেছি এবং ২০১১ সালে সরাসরি নির্বাচনে আমি ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রি অ্যাসোসিয়েশনের আর্লি ক্যারিয়ার সাইকিয়াট্রি কাউন্সিলের অস্ট্রেলেশিয়া অঞ্চলের সভাপতি নির্বাচিত হই।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশ কিছু কাজ করার ইচ্ছা আছে। শিশুদের বাবা-মাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ইচ্ছা আছে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। শুধু অসুস্থ শিশু নয়, সুস্থ শিশুদের বাবা-মাকেও এই প্রশিক্ষণ দিতে চাই।
আমার কাছে মনে হয়, কর্মই ধর্ম। কাজ করতে হবে। একটি কাজ শেষ হয়ে যাওয়া মানে আরেকটি কাজের জন্য প্রস্তুত হওয়া। ক্রমাগত কাজ করে যেতে হবে।
আমি পড়তে খুব পছন্দ করি। আর পছন্দ করি ঘুরে বেড়াতে। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জেলাই আমার বেড়ানো হয়েছে।
আমি সাইকিয়াট্রিতে অবদানের জন্য অধ্যাপক হেদায়েতুল ইসলাম গোল্ড মেডেল পেয়েছি। সাইকিয়াট্রির একটি রেফারেন্স বই রুটলেজ হ্যান্ড বুক অব সাইকোলজি ইন এশিয়ার একটি অধ্যায় অধ্যাপক গোলাম রব্বানি স্যারের সঙ্গে মিলে লেখা।
মনোচিকিৎসক হতে হলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রচুর পড়তে হবে
জ্ঞান ও দক্ষতা থাকলে সাইকিয়াট্রিতে সহজেই ডিগ্রি পাওয়া যাবে। তবে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়া যাবে না। আমি মনে করি, ভালো মানসিক রোগের চিকিৎসক হতে হলে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও প্রচুর পড়তে হবে। বদরের যুদ্ধ থেকে শুরু করে মেরিলিন মনরো পর্যন্ত সব জানতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জানতে হবে। হিউম্যান সাইকোলজি খুব কঠিন জিনিস। সব ধরনের ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্ম আর দর্শন পড়তে হবে। বুদ্ধ দর্শন না জানলে সাইকিয়াট্রি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
প্রচুর না পড়লে মানুষের মানসিকতা বোঝা যাবে না। তাদের সেবা করা কঠিন হয়ে পড়বে। যারা সাইকিয়াট্রিতে ক্যারিয়ার করতে চায়, তাদের চ্যালেঞ্জ নেওয়া শিখতে হবে।