মহৎ পেশার মানুষ
জীবনে কোথাও অতৃপ্তি নেই : অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী

বড় ভাই তাঁর আদর্শ ছিলেন। ভাই চাইতেন তিনি চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করুন। শেষ পর্যন্ত হয়েছেনও তাই। তবে হয়েছেন বিশেষ ধরনের চিকিৎসক— সাইকিয়াট্রিস্ট। যার কথা বলছি তিনি অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী। তিনি বাংলাদেশ সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসএবিলিটি প্রটেকশন ট্রাস্টের চেয়ারপারসন।
সদালাপি, সুহৃদ এই মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প।
বড় ভাইয়ের স্বপ্ন
আমার জন্ম বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কাশিয়াবালায়, ১৯৫৩ সালের ২০ মে। আমরা তিন ভাই এক বোন । বাবা গনজের আলী ছিলেন ব্যবসায়ী । উনি ছিলেন মজার মানুষ। তাঁকে সব কাজই করতে দেখতাম। ব্যবসা করতেন, দোকান সামলাতেন, কৃষিকাজ করতেন। আমার মায়ের নাম সাখাতন বেগম। জন্মের সময় নানি মারা যান। মা মানুষ হয়েছিলেন ফুপুর কাছে।
ছোটোবেলায় আমি খুব ধর্ম-কর্ম করতাম। আমাদের এলাকায় একজন কামেল লোক (ওলি) আসতেন। অনেকে তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস পেত না। কিন্তু আমি তার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
ছোটোবেলায় ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। প্রত্যেক মানুষই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে বড় কিছু হওয়ার। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
আমার বড় ভাই ইউসুফ উদ্দিন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কাজ করতেন। তিনি আমার গাইড, ফিলোসফার, মেন্টর। এক কথায় আমার পথপ্রদর্শক। উনার জীবনের স্বপ্নই ছিল আমাকে ঘিরে। অষ্টম শ্রেণীতে যখন পড়ি, ১৯৬৬-৬৭ সালে, উনি আমাকে ১০ পাতার একটি চিঠি লেখেন পাকিস্তান (তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে। সেই চিঠিতে আমার জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত, সেটি নিয়ে অনেক কিছু লেখেন। উনি আমাকে বলেন, তুমি যেমন মানুষ, এতে আমার মনে হয় চিকিৎসক হলে ভালো করবে। দিন শেষে হালাল রুজি করতে পারবে, আর মানুষের সেবাও করা হবে।
আমার কাছেও পেশাটিকে আর্কষণীয় মনে হয়েছে। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চিকিৎসক হব। তাই নবম শ্রেণীতে উঠে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিলাম। আমি পড়তাম শেরপুর ডায়মন্ড জুবিলি হাইস্কুলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নজির আহম্মেদ। তিনি তাঁর জীবনের কাহিনী আমাদের বলতেন। শুনে খুব উৎসাহিত হতাম।
স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন হিন্দু। তাঁরা আমাকে অনেক স্নেহ করেছেন। মেট্রিক পাস করি ১৯৭০ সালে। এরপর রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই সেই সময়। যুদ্ধশেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেই।
আমার বড় ভাই পাকিস্তানে আটকা পড়েন। আমার কাছে উনার চিঠি আসত ইউনিসেফের হাত দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে আটকে থাকা বাঙালি পরিবারকে এ দেশে ৪০০ টাকা করে ভাতা দিতেন সে সময়।
ভাই বললেন রাজশাহীতেই পড়
ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর বড় ভাই সেখান থেকে চিঠি পাঠালেন। বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তোমার ঢাকা যাওয়ার দরকার নেই। রাজশাহীতেই পড়াশোনা করাটাই তোমার জন্য এখন ভালো।’
তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। এমবিবিএস পাস করার পর রাজশাহীর পুঠিয়া থানায় চাকরি হলো। এরপর পোস্ট হলো বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। এরপর এফসিপিএস পড়ার জন্য ঢাকায় এলাম। মেডিসিনে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত কাকতালীয়ভাবে সাইকিয়াট্রি বিভাগেই ভর্তি হই।
এরপর ১৯৮৫ সালে এক বছরের জন্য ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের তত্ত্বাবধানে ব্যাংকক, শ্রীলংকায় প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর ব্যাঙ্গালুরুতে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৬ সালে ১০ মাস সেখানে প্রশিক্ষণ নিই।
চাইল্ড সাইকিয়াট্রিতে সব মিলিয়ে প্রশিক্ষণ ছিল চার মাস। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে পার্ট টু এফসিপিএস শুরু করলাম। ১৯৮৮ সালে এফসিপিএস পার্ট টু পাস করার পর সেন্ট্রাল ট্রিটমেন্ট সেন্টার ফর ড্রাগ এডিকশনে কাজ করা শুরু করি। সেখানে অধ্যাপক নাজিমুদ্দৌলা চৌধুরী ছিলেন প্রধান। ওখানে রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে কাজ করি। ওখান থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা হয়।
১৯৯১ সালে আইপিজিএমআর-এ নিয়োগ হয়। ১৯৯২ সালে ফেলোশিপ করি ইন্টারন্যাশন্যাল ভিজিটর প্রোগ্রাম অব ড্রাগ এডিকশন অ্যান্ড ট্রিটমেন্টে। দেশের বাইরে যেতে হয়। ফিরে এসে দেখি বদলি হয়ে গেছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। এখান থেকে যাওয়ার পর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হয়ে গেলাম। তখন বিভিন্ন রকম দায়িত্ব পালন করি। সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ডিরেক্টর ও ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করি, ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত।
এরপর ২০০২ সালে বদলি হয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড এডোলোসেন্স ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
২০০৬ সালে পুরোপুরি অধ্যাপক হলাম। ২০০৯ সালে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর কাম প্রফেসর হই। ২০১২ পর্যন্ত সেখানে ছিলাম।
এই সময় কিছু ভালো কাজ করা হয়। ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রি অ্যাসোসিয়েশনের আঞ্চলিক কংগ্রেস হয় সোনারগাঁ হোটেলে। এর পুরো দায়িত্ব পালন করি তখন।
২০১১ সালে দ্য ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের অনারারি সদস্য পদ লাভ করি। ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তিনটি বড় গবেষণা হয়েছে বাংলাদেশে। আমার দল আর আমি মিলে এই কাজগুলো করি। কাজগুলোর মধ্যে ছিল, এডাল্ট সাইকিয়াট্রি সার্ভে- কতজন মানুষ মানসিক রোগে ভোগে তার গবেষণা। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগ ও এপিলেপসি আছে কতজনের মধ্যে- সেটার জরিপ। মৃগী রোগীদের কতজন চিকিৎসা পাচ্ছে আর কতজন পাচ্ছে না এবং এ বিষয়ে শূন্যতা কীভাবে কমানো যায়- এ নিয়ে গবেষণা হয়। এসব গবেষণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আমার নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়।
২০১৩ সালে অবসরে যাই। ২০১৩ সালে পিআরএল হলো (পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ)। এরপর পপুলার মেডিকেল কলেজে যোগ দিলাম। এখানে স্টাডি গ্রুপ তৈরি করি অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য মেন্টাল হেলথ ইন বাংলাদেশ নামে।
২০১৪ সালের পহেলা জুলাই সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রস্টের চেয়ারপারসন হিসেবে যোগ দেই। এখানে চার ধরনের মানুষের কাজ করা হয়। এক. অটিজম, দুই. ডাউন সিনড্রম, তিন. সিরাবল পালসি, চার. ইন্টেলেকচুয়াল ডিজএবিলিটি। এ ছাড়া নতুন যারা আছে তাদের খুঁজে বের করা। পুরোনো যারা তাদের বাবা-মাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সমাজে পুরোপুরিভাবে পুনর্বাসন করা।
এ ছাড়া ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতা নিয়ে ১৮টি দেশের অংশগ্রহণ করা একটি গবেষণায়ও কাজ করছি।
আমার কোথাও পরাজয় নেই
নিজেকে কখনো পরাজিত ভাবি না আমি। আমার কোথাও পরাজয় নেই। যা কল্পনা করি সেটা পাই। আল্লাহ আমাকে সেটা দিতে সাহায্য করেন। আমার কোনো কিছু না থাকলেও আমি সন্তুষ্টি বোধ করি। জীবনের ক্ষেত্রে আমি তৃপ্ত। অতৃপ্তি নেই কোথাও।
১৯৮১ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করি। আমার স্ত্রীর নাম মাহরুফা হোসেন। তিনি সমাজকর্মী। আমার একটিই ছেলে, আর্কিটেক্ট।
আমার বর্তমান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে, নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজএবিলিটির ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সমাজে পুনর্বাসন করার জন্য তাদের পিতামাতা ও তাদের সেবায় যারা যুক্ত আছে তাদের প্রশিক্ষিত করা।
মানুষের জন্য কাজ করা বড় কথা
যখন একজন মানসিকভাবে অসুস্থ রোগী ভালো হয়ে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে তখন ভালো লাগে। নতুন যারা এই পেশায় আসছে তাদের বলব, মানুষের জন্য কাজ করতে। মানুষের জন্য কাজ করাটা বড় কথা। মানুষের জন্য কাজ করলে সুনাম-খ্যাতি সবই আসবে।