শিশুর সঙ্গে মা-বাবার আচরণ ও করনীয়
সাধারণত দুই বছর বয়স থেকে কোনো কোনো শিশুর মধ্যে মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি, জিনিসপত্র ভাঙা ইত্যাদি আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায়। শিশুর ক্রোধের কারণ ও প্রতিকারে করনীয় -
শিশুর আক্রমণাত্মক আচরণ
কারণ
সাধারণত শিশু তার শক্তি ও বাড়তি সামর্থ্যকে যদি কোনো গঠনমূলক কাজে ব্যয় করার সুযোগ না পায়, তখন সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
অনেক সময় হতাশা থেকেও শিশু এ রকম আচরণ করে। যেমন কোনো কাজে বাধাপ্রাপ্ত হলে এবং যা সে করতে চায় তাতে ব্যর্থ হলেও আক্রমণাত্মক আচরণ করে থাকে।
মা-বাবার অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ, তাঁদের পর্যাপ্ত স্নেহের অভাবে অনেক সময় শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
যেসব শিশু অবহেলিত ও অনাথ আশ্রমে লালিত, সেসব শিশুর মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেশি দেখা যায়। তারা প্রথমেই আক্রমণকে আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় বলে মনে করে।
অনেক সময় অতিরিক্ত ক্ষুধা থেকে বা অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লে শিশু আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
শিশুর বিভিন্ন চাহিদা পূরণ না হলেও তারা অনেক সময় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
যেসব শিশু প্রায়ই অসুস্থ থাকে তাদের মধ্যেও মাঝে মাঝে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায়।
পিঠাপিঠি ভাই-বোনের একে অপরের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব থেকেও শিশু মাঝে মাঝে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
প্রতিকারে করনীয়
প্রথমে মনে রাখতে হবে যে শিশুর প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা ও শাসনের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। কোনোটাই মাত্রাতিরিক্ত করা যাবে না।
পরিবারের একতা, মা-বাবার মধুর সম্পর্ক—শিশুর বেড়ে ওঠা ও আচরণের ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব শিশু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং যাদের মধ্যে নিরাপত্তা বোধের অভাব নেই, তারা হতাশাকে দ্রুত আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারে। তাই শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে।
ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ অনেক সময় শিশুর হতাশা প্রকাশের একটি মাধ্যম। সে সময় রেগে না গিয়ে শান্ত থাকুন এবং আচরণের পিছনের কারণ বুঝুন ।
মাটির মডেলিং, বিল্ডিং ব্লক বা স্ট্রেস বলের মতো নিরাপদ কার্যকলাপের সাথে তাদের ব্যস্ত করুন।
শারীরিক কার্যকলাপে যেমন দৌড়ানো, লাফানো বা খেলাধুলায় যুক্ত করতে উৎসাহ দিন।
স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা স্থাপন করুন। শিশু যখন শান্ত থাকবে তখন সহজ এবং ধারাবাহিক ভাষায় তাদের জানিয়ে দিন কোন আচরণ গ্রহণযোগ্য এবং কোনটা নয়। বোঝানোর সময় অবশ্যই বাচ্চার সামনে একই লেভেলে বসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে তারপর বলবেন।
ভালো আচরণের জন্য প্রশংসা করুন এবং ছোট ছোট পুরস্কার প্রদান করুন।যেমন, কোন খেলনা, কালার পেন্সিল ইত্যাদি।
তাদের কার্যকলাপের উপর নজর রাখুন এবং ধ্বংসাত্মক প্রবণতা দেখালে তাদের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দিন।তাদের আগ্রহের সঙ্গে মিল রেখে আকর্ষণীয় কাজের প্রস্তাব দিন। যেমন, চলো আমরা রং করি, চলো আমরা বাইরে যাই ইত্যাদি।
তাদেরকে তাদের কর্মকাণ্ডের পরিণতি সম্পর্কে বোঝান। যেমন, তুমি এটা ভাংলে ভাঙা অংশ দিয়ে তোমার পা কেটে যেতে পারে।
ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পরিবর্তে অনুভূতি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করার উপায় শিখান। যেমন, আমার খারাপ লাগছে, আমার রাগ লাগছে, আমি এটা চাচ্ছি ইত্যাদি।
ভাঙার উপকরণ বা ক্ষতিকর জিনিসগুলো তাদের নাগালের বাইরে রাখুন।
শিশুকে এসব ক্ষেত্রে মারধর করা যাবে না। তাতে ক্রোধ আরো বেড়ে যাবে।
তাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করাতে হবে যে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আচরণ অগ্রহণযোগ্য। এ জন্য মা-বাবাকে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। উত্তেজনার মুহূর্তে স্থির থাকতে হবে।
যখন শিশুর অন্যায় আবদার মানা সম্ভব হবে না, তখন তার মনোযোগ অন্যদিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করুন।
শিশুর এই আচরণ সমর্থন না করলেও আদর ও ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে দৃঢ় থাকুন ও হালকা শাস্তি দিন। শাস্তি অবশ্যই বয়স উপযোগী, সময়োচিত ও পরিমিত হতে হবে।
শিশুকে এমন সব কাজে ব্যস্ত রাখুন, যাতে ওর শক্তি গঠনমূলক কাজে ব্যয় হয়। যেমন—ছবি আঁকা, নাচ-গান শেখা, দলবদ্ধভাবে ও নাটকীয় খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, বাগান করা ইত্যাদি।
ধৈর্যের সঙ্গে সঠিক উপায় অবলম্বন করলে শিশুর আক্রমণাত্মক আচরণ দূর হয়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু নিজেও পরিপক্ব হয়ে ওঠে এবং বুঝতে শেখে ভালো ও মন্দ আচরণের তফাত।
শিশুর ধংস্বাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণের সময় আপনার ধৈর্য এবং সহানুভূতি সবচেয়ে প্রয়োজন।
সহযোগী অধ্যাপক, পালমনোলজী বিভাগ, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউট।