‘মাসিক’ নিয়ে ‘চুপ’ থাকার সংস্কৃতি কমছে

মাসিক বা পিরিয়ড নারীদের একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক হলেও ‘মাসিক’ বা পিরিয়ড নিয়ে সামাজিকভাবে এখনও নানা ধরনের আতঙ্ক কাজ করে নারীদের। বিশেষ করে গ্রামের কর্মজীবী নারীরা বেশ আতঙ্কে থাকেন। কেউবা মাসিকের সময়টাতে ঘর থেকে বেরই হন না। যদিও সামাজিক ও পরিবার শিক্ষা এ বিষয়ে মেয়েদের সচেতন করে তুলতে পারে। আর এ সচেতনতার সৃষ্টিতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে যেখানে ‘মাসিক’ বা পিরিয়ড ছিল গোপন বিষয়, এখন তা নিয়ে সরাসরি কথা বলছেন বিভিন্ন বয়সী নারীরা।
২০১৬ সাল থেকে বয়ঃসন্ধি ও মাসিক বা পিরিয়ড সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ‘ঋতু’। পিরিয়ড নিয়ে সামাজিক-পারিবারিক ট্যাবু প্রসঙ্গে ‘ঋতু’র প্রতিষ্ঠাতা শারমিন কবির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পিরিয়ড নিয়ে আমাদের পরিবারগুলোতেই এক ধরনের বাধা ছিল। বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইতো না। বর্তমানে বিষয়টি খুবই সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিচ্ছে। পিরিয়ড নিয়ে এখন বই আছে, কমিক আছে, বাবাদের জন্যও বিভিন্ন আর্টিকেল রয়েছে। আমরা চেষ্ট করছি এটাকে স্বাভাবিক করার জন্য।
বড় হওয়ার মতো পিরিয়ডও একটি স্বাভাবিক বিষয় বলে মন্তব্য করেন শারমিন কবির। তিনি বলেন, আমরা এখন স্কুলগুলোতে ছেলেদের সাথেও পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা করছি। ছেলেদেরও এ বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে। তাদেরও সচেতনতার আওতায় আনতে হবে। এটা কোনো গোপন বিষয় নয়।
প্রথমবার পিরিয়ডের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মেয়ে ভেরিফাইড বা ফরমাল ইনফরমেশন খুবই কম পায়। ইনফরমেশন থেকে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে মেন্টাল সাপোর্ট, বিশেষ করে— পিরিয়ড কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, কীভাবে এটা মেনটেইন করবে, কেন এটা তোমার জন্য আশীর্বাদ, এটা অভিশাপ না— এই জিনিসগুলো আমরা কেউ বলি না।
পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে ‘ঋতু’র কার্যক্রম নিয়ে শারমিন কবির বলেন, আমাদের কাজের প্রধান জায়গাটা হচ্ছে বয়ঃসন্ধি ও পিরিয়ড। এই কাজের জন্য আমাদের তিনটা অ্যাপ্রোচ আছে। প্রথমটা হচ্ছে— সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মশালা। স্কুলে স্কুলে ছেলেমেয়ের সমন্বয়ে গ্রুপ করে দিই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। কারও কোনো সমস্যা হলে ওই গ্রুপের মাধ্যমে যে কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। শুধু মেয়েদেরই নয়, তাদের মা-বাবা ও স্কুলের ছেলে বন্ধুদেরকেও পিরিয়ড নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বলেন তিনি।
বয়ঃসন্ধির শুরু থেকেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা কথা বলে বিষয়টি স্বাভাবিক করে ফেলা উচিত। প্রথম মাসিকের আগে ও পরের প্রয়োজনীয় তথ্য মেয়েদের জানানো উচিত।
তিনি বলেন, আমরা একটা ঋতু কমিক গ্রুপ বানিয়েছি যেটা অবচেতনভাবেই সবার মাঝে পিরিয়ড সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি করবে। আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন করছি যেটা পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত।
পিরিয়ড নিয়ে সরকারের উদ্যোগগুলো ভালো বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন স্কুলগুলোতে পিরিয়ড ক্লাব আছে, আলাদা বাথরুম আছে। তবে মনিটরিং নেই ঠিকমতো। বাজেটেরও কমতি রয়েছে। সরকারের সঠিক মনিটরিং আর পরিবারের সচেতনতাই পারে এ ট্যাবু আর আতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে।
পিরিয়ড নিয়ে কথা হয় দিনাজপুর মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের (বাংলা স্কুল) সহকারী শিক্ষক সুপ্তা রায়ের সঙ্গে। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক স্মার্ট। তাই বলতে গেলে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আপনি যদি ১০-১৫ বছর আগের দিনগুলো দেখেন, তখন বিষয়টি নিয়ে কেউ কথাই বলতো না। মনে করা হতো এটা পাপ। সেই জায়গা থেকে আমরা অনেকটা সরে এসেছি। মেয়েরা এখন মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে আমাদের জানায়, আমরা তাদের সাহায্য করি। বাসায় পৌঁছে দেই। তবে পুরোপুরি এই ট্যাবু থেকে বের হওয়া গেছে, তা বলা যাবে না। গ্রামগুলোতে এখনও পুরোনো কাপড় ব্যবহার করা হয়। স্বাস্থ্য নিয়ে তারা সচেতন নয়। যদিও এখন অনেকগুলো এনজিও কাজ করছে।
সুপ্তা রায় বলেন, বিভিন্ন স্কুলে ন্যাপকিন ও অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা হচ্ছে। মেয়েরা সেগুলো আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। এটা যুগান্তকারী উদ্যোগ। পিরিয়ড নিয়ে চুপ থাকার সংস্কৃতি ‘অনেক কমেছে’ বলেও মনে করেন এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, যেমন আমার স্কুলে মেয়েরা এখন দরখাস্তের মধ্যে নিঃসংকোচে বলে, ‘ম্যাম/স্যার, আমার পেট ব্যথা হচ্ছে।’ পেট ব্যথা বললে আমরা বুঝি যে কি অবস্থা। আমরা ছুটি দিয়ে দিই। হঠাৎ করে কোনো মেয়ের সমস্যা হলে সেটার জন্য ম্যাডামের কাছে সব রাখা আছে।
সরকারের ভূমিকা
দেশের সব স্কুলেই এখন মেয়েদের জন্য রয়েছে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে সংরক্ষণ করা হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন। মেয়েরা যদি কেউ কেয়ারলেস হয়ে বা পিরিয়ডের টাইম তাদের মনে নাই— এমন অবস্থায় স্কুলে চলে আসে সেক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক ব্যবস্থা নেন। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা হয়েছে মাসিক নিয়ে প্রবন্ধও।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন কিংবা গার্লস এডুকেশন— দুই ক্ষেত্রেই মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা আছে।