করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ

করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল মিলনায়তনে মঙ্গলবার (২৪ জুন) এক সেমিনারে উপাচার্য এ কথা বলেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (বিএমইউ) করোনা, ডেঙ্গু জ্বরের সাম্প্রতিক প্রবণতা (এন ওভারভিউ অফ কারেন্ট ফিভার ট্রেন্ডস ইন বাংলাদেশ) নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কনটিনিউইং মেডিক্যাল এডুকেশন (সিএমই) প্রোগ্রামে তিনি একথা বলেন।
ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই সিএমইতে রিসেন্ট ট্রেন্ড ইন ফেব্রাইল ইলনেসেস ইন বাংলাদেশ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান, কোভিড-১৯ ট্রেন্ড ২০২৫ ইন বাংলাদেশ: এভিডেন্স বেইসড ইনফরমেশন বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী ও ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান।
অনুষ্ঠানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা বিষয়ে অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, ইভিডেন্স বেইসড মেডিসিনের ওপর ভিত্তি করে গাইডলাইন অনুসরণ করে। যদি গাইডলাইন অনুসারে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় তাহলে রোগী যেমন সঠিক বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা পাবেন আবার চিকিৎসা ব্যয়ও কমে আসবে। একই সাথে রোগীর আরোগ্য লাভে ও জীবন বাঁচাতেও বিরাট ভূমিকা রাখবে।
সভাপতির বক্তব্যে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) ও ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনার বিস্তার রোধে সীমান্ত এলাকায় সতর্কতা অবলম্বনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মাস্ক পড়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার সময় উপযোগী ও বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা নিতে হবে।

প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান হাওলাদার তার বক্তব্যে ডেঙ্গু চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার ওপর আরো গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. খালেদ মাহবুব মোর্শেদ মামুনের সঞ্চালনায় প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেসিক সায়েন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী, ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, অধ্যাপক ডা. আব্দুল কাদের, অধ্যাপক ডা. কাজী মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. তানভীর ইসলাম, অধ্যাপক ডা. ফেরদৌস উর রহমান প্রমুখ।
কোভিড-১৯ গাইডলাইন
সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী তার উপস্থাপিত ‘কোভিড-১৯ ট্রেন্ড ২০২৫ ইন বাংলাদেশ: এভিডেন্স বেইসড ইনফরমেশন’ উপস্থাপিত প্রবন্ধে জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে রোগীরা ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের সাব-ভেরিয়েন্ট JN.1 এর শাখা ভেরিয়েন্ট XFG, XFC দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ভেরিয়েন্টগুলোর অন্য রোগীদের আলাদা করে তীব্র মাত্রায় অসুস্থ করার সম্ভাবনা নেই। তবে এ ভেরিয়েন্টগুলোর ওপর নিয়মিত মনোযোগ রাখতে হবে।
ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী আরও জানান, ফাইজার ও বায়োনটেক কোম্পানি ওমিক্রন JN.1 ভেরিয়েন্ট প্রতিরোধী মডিফাইড ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে বাজারে নিয়ে এসেছে। যদিও এই ভ্যাকসিন আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তবে পূর্বে যারা বুস্টার ডোজসহ ন্যূনতম তিন ডোজের ভ্যাকসিন নিয়েছেন তারা এই ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারবেন। সেক্ষেত্রে তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হতে পারেন কিন্তু তার তীব্র মাত্রার কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা ভ্যাকসিশনের কারণে অনেকাংশে কমে যাবে।
ডেঙ্গু গাইডলাইন
‘ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫ : হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড’ বিষয়ক প্রবন্ধে সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের হালকা উপসর্গে যেমন (৩-৫ দিন জ্বর, মাথাব্যথা, হালকা গায়ে ব্যথা) রোগীকে বাড়িতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য কেবল প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে (২৪ ঘণ্টায় ৩ গ্রামের বেশি না)। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা ব্যথানাশক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। জ্বর কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়া, বারবার বমি, পেটব্যথা, রক্তপাত, ঘন ঘন দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বা মলিন চামড়া, অস্থিরতা, অজ্ঞানভাব, মাথা ঘোরানো— এই উপসর্গ দেখা গেলে এবং গর্ভবতী নারীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
এসময় স্টেরয়েড (যেমন ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকরটিসন) ব্যবহার রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় প্রমাণিত, এতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কোনো উপকার হয় না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে স্টেরেয়ড বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ব্যবহার করা যাবে।
ডেঙ্গু গাইডলাইনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই জানিয়ে সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান তার প্রবন্ধে বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। শুধুমাত্র যদি নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ থাকে (যেমন নিউমোনিয়া), তখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অকার্যকর ও বিপজ্জনক। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে পেঁপে পাতার রস ও অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করছেন। তবে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, পেঁপে পাতার রসে প্লাটিলেট বাড়ানোর বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এছাড়াও ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা ও লিভারের সমস্যাও হতে পারে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় এটি কোনো বিকল্প নয়। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ এবং সময়মতো হাসপাতালে যাওয়াই এখনও সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
ডা. নাজমুল হাসান জানান, প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন প্রয়োজন হয় তখনই যদি রোগীর প্লাটিলেট সংখ্যা খুব কম (১০,০০০-এর নিচে), রক্তপাত হচ্ছে অথবা অপারেশন বা ইনভেসিভ প্রসিডিউরের প্রয়োজন পড়ে। শুধুমাত্র প্লাটিলেট কম থাকলেই রক্ত দেওয়া উচিত নয়। এতে অতিরিক্ত চাপ বা জটিলতা দেখা দিতে পারে। সম্পূর্ণ রক্ত বা রেড ব্লাড সেল ট্রান্সফিউশন, শুধুমাত্র তখনই বিবেচ্য, যখন রোগীর হিমোগ্লোবিন খুব কম বা রক্তপাতজনিত শক দেখা দেয়। সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার ও ফিভার ক্লিনিক চালু করা প্রয়োজন। আইভি ফ্লুইড, রক্ত, রক্তের উপাদান ও জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনায়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জমে থাকা পানির পাত্র পরিষ্কার করা, ঘরের ভিতর ও বাইরের জলাধার ঢেকে রাখা, সপ্তাহে অন্তত একবার পানি ফেলে দেওয়া ও ব্লিচিং করা প্রয়োজন। কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও স্প্রে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে ভুল চিকিৎসা ও গুজব ডেঙ্গুকে মারাত্মক করে তোলে। সরকারি নির্দেশনা মেনে চললে এবং নিজের আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জ্বরজনিত সমস্যা
সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান উপস্থাপিত ‘রিসেন্ট ট্রেন্ড ইন ফেব্রাইল ইলনেসেস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানান, চলমান বর্ষা মৌসুমে জুন-অক্টোবর হঠাৎ করেই জ্বরজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও বহিঃবিভাগে। ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও কোভিড আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়ছে। তাই রোগ নির্ণয়ে সচেতনতা ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু : প্রতি বছর বর্ষা এলেই আমাদের ডেঙ্গু আতঙ্ক ফিরে আসে, এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগে ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি মনে করা হলেও এখন সারাদেশেই বিভিন্ন জেলায় এর সংখ্যা বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বর্তমানে বরিশাল ও বরগুনা জেলায়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও পরিবর্তিত জলবায়ুর ধারা ডেঙ্গু সংক্রমণের মূল কারণ। চলমান মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮৭৭ জন এবার (DENI, DEN2 এবং DEN3) সেরোটাইপ দিয়ে নতুনভাবে সংক্রমণ হচ্ছে। এ সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে ঢাকা জেলায় দুজন ও বরিশাল জেলায় ৫ জন মারা গেছেন বলে জানা যায়। শিশুদের পাশাপাশি এখন বড়দেরও (বিশেষ ১৬-২৫ বছর) ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি।
চিকুনগুনিয়া : ২০১৭ সালের পর পুনরায় চিকুনগুনিয়ার প্রার্দুভাব বিগত বছরগুলোতে বেড়েছে, ১৯ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ২২ এপ্রিল ২০২৫ এর মধ্যে ৫২০ জন সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ১৬১ জনই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কম হলেও জ্বর পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (গিটে ব্যথা, র্যা শ, দুর্বলতা) রোগীদের জীবনমানে বিস্তর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে, তাই এটি সাধরণ ভাইরাস জ্বর ভেবে উপেক্ষা করা উচিত নয়।
কোভিড : কোভিড-১৯, ২০২০ সালে মহামারী আকার নিলেও এর সংক্রমণ ঝুঁকি এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এটি একটি পরিবর্তনশীল ভাইরাস যা পূর্বে (আলফা, বিটা, ডেলটা অমিক্রন) ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে ওমিক্রনের সেরোটাইপ (XFG এবং XFC) হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শনাক্ত করা হয়েছে। পূর্বের চেয়ে এবারের সেরোটাইপের সংক্রমণের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। এমনকি আগেরবার করোনায় আক্রান্ত বা টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও এর ঝুঁকি রয়েছে। চলমান বছরে ১৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছেন; যার মধ্যে বিগত ২৪ ঘণ্টায় এর সংখ্যা ৫ জন।
উল্লেখ্য, সাধারণভাবে শরীরে জ্বর থাকলে এবং জ্বরের সাথে কোনো রোগ বা অসুস্থতা থাকে, তখন তাকে ফেব্রাইল ইলনেস বলা হয়।