টক্সোপ্লাজমোসিস : এক নীরব ঘাতক

অনেক গর্ভবতী নারী নিজেদের অজান্তে তাঁদের গর্ভস্থিত শিশুর মধ্যে এক ধরনের পরজীবী সংক্রমণ স্থানান্তর করেন, যাকে বলে টক্সোপ্লাজমোসিস। পরজীবীটির নাম টক্সোপ্লাজমা গোন্ডাই। প্রতি এক হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে একটি অথবা দুটি শিশু এই জীবাণুতে সংক্রমিত হয়। শিশুর ত্রুটিপূর্ণ জন্মের জন্য অনেকটাই দায়ী হলো টক্সোপ্লাজমোসিস। এসব শিশুর শতকরা ৩০টিই কেন্দ্রীয় স্নায়ু ব্যবস্থার এবং চোখের ক্ষতি নিয়ে জন্ম নেয়। অন্যান্য নবজাতকে স্বাভাবিক দেখালেও বছরের শেষে তাদের অন্ধত্ব, কুষ্ঠরোগ কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যদি শিশু জন্মানোর পূর্ববর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়মিত করা হয় এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে গণশিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ভয়াবহ সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে কমে যাবে।
রোগের কারণ ও উপসর্গ
রোগের কারণ হলো টক্সোপ্লাজমা গোন্ডাই নামক জীবাণু। বিড়ালের সংস্পর্শে এলে কিংবা পশুর গোশত ভালোভাবে রান্না করে না খেলে এই জীবাণু মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। শতকরা ৩৫ জন লোক এই মারাত্মক পরজীবী বহন করেন। কিন্তু অনেকেই মাংসপেশি ও অন্যান্য টিস্যুতে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। প্রায় ১০ শতাংশ লোকের এক অথবা দুই সপ্তাহের জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের উপসর্গের অভিজ্ঞতা ঘটে। সাধারণত জ্বর, গা ম্যাজম্যাজ করা, মাথাব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি, লিভার প্রদাহ, চোখে ব্যথা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। এ সময় লিম্ফেগ্রন্থি ফুলে যায়।
গর্ভবতী নারী এ জীবাণুতে আক্রান্ত হলে গর্ভস্থ শিশুর জন্য তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নারীর দেহে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি না হলে তা প্লাসেন্টার মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুকে আঘাত হানে। ভ্রূণের বিকাশের সময় যদি মা আক্রান্ত হন, তাহলে শিশুর জন্য তার ফল হয় ভয়াবহ। কিন্তু গর্ভাবস্থার তিন মাস পরে মা আক্রান্ত হলে ফল ততটা মারাত্মক হয় না।
কী চিকিৎসা নিতে হবে?
গর্ভাবস্থায় একজন নারী সংক্রমিত হলে আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি এবং লিম্ফগ্রন্থির বায়োপসি পরীক্ষা করলে রোগ নির্ণয় নিশ্চিত হবে। মাকে সন্তান পেতে হলে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের কালচার এবং ভ্রূণের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। যদি ভ্রূণ সংক্রমিত হয়, তাহলে তাঁর জন্মগত ত্রুটি সীমিত কিংবা প্রতিরোধ করতে গর্ভবতী মায়ের ড্রাগথেরাপি শুরু করতে হবে। পছন্দনীয় চিকিৎসার ধারা হলো পাইরিমেথামিন এবং সালফাডিমিডিন ওষুধের মিশ্রণ। সংক্রমণের বৃদ্ধি কমাতে এই মিশ্রণ গর্ভাবস্থায় দেওয়া হয়। অন্য একটি ওষুধ রয়েছে স্পাইরামাইসিন। এই ওষুধ ইউরোপে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হলেও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিশেষ অনুমতি ছাড়া কোনো কোনো দেশে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিলম্বিত জটিলতার ঝুঁকি কমাতে শিশুর জন্মের পর অবিরাম ড্রাগ থেরাপি চালিয়ে যেতে হবে।
কীভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে?
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর যাতে সংক্রমণের বিকাশ না ঘটতে পারে, সে জন্য গর্ভধারণের আগে টক্সোপ্লাজমোসিসের জন্য স্ক্রিনিং করাতে হবে। যদি পজিটিভ ফল আসে, তাহলে বুঝতে হবে ওই নারী জীবাণুর জন্য অ্যান্টিবডি বহন করছেন, যার অর্থ ভয়ের কিছু নেই। যদি পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল আসে, তাহলে নারীকে সংক্রমণ এড়াতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাঁকে গর্ভধারণের আগ পর্যন্ত নানা ধরনের রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে আপনাকে কিছু উপায় মেনে চলতে হবে :
— বাসায় বিড়াল থাকলে তা যেন আপনার শোবারঘরে না ঢোকে, সে ব্যবস্থা করুন।
— বিড়াল পোষার অভ্যাস থাকলে পোষা বিড়াল যেন ইঁদুর বা পোকামাকড় শিকার না করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। তাকে কাঁচা মাছ বা গোশত কখনোই খেতে দেবেন না। আপনার হাঁড়ি-পাতিলে কিংবা থালাবাসনে কখনোই তাকে মুখ দিতে দেবেন না।
— যেসব জায়গায় বিড়াল পায়খানা করে, সেসব জায়গা থেকে দূরে থাকুন। আপনার বিছানায় এবং আপনার কোলে যত্রতত্র যেন সে না ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
— গোশত রান্না করার সময় উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করুন। কখনোই কম বা অর্ধসেদ্ধ গোশত খাবেন না।
— কাঁচা গোশত ধরার পরে সাবান দিয়ে ভালো করে আপনার হাত পরিষ্কার করুন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।