স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে ঝুঁকি

সন্তান প্রসবের ব্যথা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর কষ্টকর ব্যথার মধ্যে একটি। এই ব্যথার ভয়ে অনেকেই তাই স্বাভাবিক প্রসব এড়িয়ে অস্ত্রোপচার করে সন্তান প্রসব করাই শ্রেয় মনে করেন। তবে অস্ত্রোপচার না করেও ব্যথামুক্তভাবে প্রসব সম্ভব। আজ ২২ অক্টোবর এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২১৮২তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করীম কাজল।
প্রশ্ন : ডেলিভারি বা সন্তান প্রসবের বিষয়টি নিয়ে আমাদের জনমনে কিছু প্রশ্ন আছে। আমরা শুনতে পাই এখন গাইনি চিকিৎসকদের কাছে সন্তান প্রসবের বিষয়ে গেলেই তাঁরা সিজারের কথা বলেন। স্বাভাবিক প্রসবের দিকে কেউই আগ্রহ দেখান না। এই বিষয়টি কী এবং স্বাভাবিক প্রসব মানে কী?
উত্তর : নরমাল ডেলিভারি মানে হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব। অর্থাৎ একটি গর্ভে সন্তান থাকবে পূর্ণ বয়স পর্যন্ত। আর সেই গর্ভের সন্তানটি স্বাভাবিক অবস্থানে থাকবে, অর্থাৎ শিশুর মাথা নিচের দিকে থাকবে। স্বাভাবিক উপায়ে বা স্বাভাবিক নিয়মে গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনা উঠবে। শেষ পর্যন্ত একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম হবে। একজন মা সুস্থ থাকবে। এই সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে আমরা বলি স্বাভাবিকভাবে সন্তানের প্রসব।
প্রশ্ন : তবে এই স্বাভাবিক ঘটনা স্বাভাবিকভাবে হয় না। একটু ব্যাহত করে আমরা সিজারিয়ানের দিকে বেশি যাচ্ছি বলে একটি আলোচনা আছে। এর যথার্থতা কতখানি?
উত্তর : এর যথার্থতার অনেকগুলো দিক। একটি হলো রোগীর দিক। এমনিতে কিছু কারণ রয়েছে যেগুলোর জন্য স্বাভাবিক ডেলিভারির বদলে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা প্রসব করাতে হবে। তো সেই জিনিসগুলো কী? বেশ কিছু। যেমন মায়ের যদি কোনো জটিলতা থাকে। দেখা গেল মায়ের উচ্চ রক্তচাপ আছে। কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে। অথবা মা একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছে; যেমন হার্টের রোগে ভুগছে। কিংবা মায়ের বয়স বেশি বা বয়স অনেক কম। অর্থাৎ ১৬ বছরের নিচে কিংবা ৩৫ বছরের ওপরে। কিংবা মায়ের উচ্চতাও কম। বলা হয়, চার ফুট ১০ ইঞ্চির নিচে। মায়ের দিক থেকে এসব ব্যাপারগুলো থাকে।
আর বাচ্চার দিক থেকে যেটা থাকে, গর্ভফুলটা হয়তো জরায়ুমুখের দিকে থাকে, নিচের দিকে থাকে। কিংবা বাচ্চার অবস্থান হয়তো ঠিক নেই। বাচ্চার মাথা হয়তো নিচের দিকে নেই। তা ছাড়া দেখা গেল মায়ের জরায়ুতে কোনো টিউমার আছে যে কারণে স্বাভাবিক প্রসব ব্যাহত হতে পারে। আরেকটি হতে পারে বাচ্চাটির ওজন যে রকম, বাচ্চার আকার আকৃতি যে রকম বড়, মায়ের যে তলপেটের হাড়ের খাঁচা আছে, সেটি হয়তো দেখা গেল সে রকম নয়, ছোট। সে কারণে আমরা মনে করি এখান দিয়ে হয়তো স্বাভাবিক প্রসব হবে না। এই রকম কিছু বিষয় থাকে।
কিংবা কোনো মায়ের হয়তো এ রকম থাকে আগে একবার কিংবা দুবার অস্ত্রোপচার হয়ে বাচ্চা প্রসব হয়েছে, সে কারণে তখন আমরা হয়তো স্বাভাবিক প্রসবের কথা চিন্তা না করে তাকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবই সমর্থন করি। এটা হলো বৈজ্ঞানিক তথ্য।
আরেকটা ব্যাপার, মায়ের এবং পারিবারিক দিক থেকে আমাদের ওপরে চাপ থাকে, সেটা হচ্ছে অনেক দিন পরে বাচ্চা হচ্ছে এবং কোনো পরিবার সেই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। কিংবা তারা চিন্তা করছে আমরা বেশি বাচ্চা নেব না তাহলে কেন অস্ত্রোপচার করাব না। আর একটি হলো, ব্যথার যে বিষয়টি রয়েছে সেই ব্যথা সে সহ্য করতে পারবে না।
আরো অনেক ভুল ধারণা মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। তারা মনে করছে, সিজারিয়ান ভালো। এভাবে বাচ্চা ভালোভাবে জন্ম হয়। স্বাভাবিক প্রসবে অনেক ঝুঁকি আছে। এই ভুল কিছু তথ্য মায়েদের মধ্যে ঢুকে গেছে।
চিকিৎসকের দিক থেকে যে বিষয়টি ঘটে, চিকিৎসক প্রসবকালীন সম্পূর্ণভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করবেন, সে সময়টুকু দেবেন এবং চাহিবা মাত্র ওই চিকিৎসককে পাওয়া যাবে কিংবা অফিস সময়ের বাইরে হোক কিংবা অফিস সময়ে ভেতরে হোক- এই চিকিৎসককে পাওয়া যাবে সময়মতো এটাও আসলে সম্ভব নয়। তাই চিকিৎসকের চিন্তা থাকে, আমি অস্ত্রোপচার করেই হয়তো ঠিকঠাকমতো একটি বাচ্চা প্রসব করব। এতে আমি চিন্তামুক্ত থাকলাম। এসব বিভিন্ন কারণে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাচ্চার প্রসব বাড়ছে।
প্রশ্ন : যেটা (অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব) পৃথিবীর অনেক দেশেই বাড়ছে না বা তারা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
উত্তর : হ্যাঁ, আমাদের দেশে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। যেটা আসলে হওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন : সন্তান জন্মদানের ব্যথা খুব কষ্টদায়ক। তবে এই স্বাভাবিক প্রসব কি ব্যথামুক্তভাবে করা সম্ভব?
উত্তর: বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে ব্যথা কমানো খুব কঠিন বিষয় নয়। আর প্রসব বেদনার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো ব্যথার আসলে তুলনা করে বলা যায় না। ব্যথামুক্ত প্রসব করানো খুব সহজ ব্যাপার। কিন্তু চালু নেই বলে, কেউ করছে না দেখে একটি ভীতিকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেছে। তবে উন্নত বিশ্বে কিংবা আমাদের দেশে কোথাও কোথাও ব্যথামুক্ত প্রসব হয়ে থাকে।
ব্যথামুক্ত প্রসব দুটো ভাবে হতে পারে। প্রসব বেদনা যখন চলবে তখন ব্যথার ওষুধ দিয়ে তার ব্যথা কমানো যেতে পারে। শতকরা ৯০ ভাগ পর্যন্ত ব্যথা কমানো যেতে পারে।
আরেকটি হচ্ছে আমরা সাধারণত কোমরের দিকে একটি ইনজেকশনের মতো দিয়ে, যেভাবে ঠিক সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করা হয়, ব্যথামুক্তভাবে ঠিক একইভাবে প্রসব চলাকালীন মাকে ব্যথামুক্ত রাখা যায়।
তখন মা কথা বলতে পারে। মা হালকা খাবার খেতে পারে। মা গল্প করতে পারে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে পারে। সম্পূর্ণ প্রসবকালীন ব্যথামুক্ত থাকতে পারে। সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারে।
আমরা মনে করি, ব্যথামুক্ত প্রসব যদি চালু করা যায় তাহলে অনেকখানি সিজারের হার কমে যাবে।
প্রশ্ন : অনেকে তো মনে করছে সিজার ভালো, ঝুঁকি কম। তাহলে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারে ক্ষতি কোথায়?
উত্তর : দেখুন একটি মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হয়তো হতো। কিন্তু সেই মাকে যদি অস্ত্রোপচারের একটি পদ্ধতির ভেতর যেতে হয়, তাহলে অস্ত্রোপচার মানেই তো একটি ঝুঁকি। অস্ত্রোপচারের একটি নিজস্ব ঝুঁকি রয়েছে। একটি হচ্ছে অজ্ঞানের ওষুধজনিত ঝুঁকি। আরেকটি হচ্ছে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি। কিংবা ইনফেকশনের ঝুঁকি। কাজেই মা সেখানে ঝুঁকিমুক্ত থাকছে, এ কথা সত্য নয়। অর্থাৎ যে মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হতো, অস্ত্রোপচার করে প্রসব করানোর কারণে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় হয়তো সে ভুগতে পারে। সে ক্ষেত্রেও ভোগান্তি বাড়ছে। আর্থিক খরচও বাড়ছে।
প্রশ্ন : একবার যদি সিজার হয় তাহলে সেই মায়ের কি স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়? তাকে আবারও সিজারের দিকে যেতেই হয়?
উত্তর : আগের সিজারটি কেন হয়েছিল, তার ওপর বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে। যদি এমন হয়ে থাকে যে আগে এমন কোনো কারণ ছিল যে কারণে মায়ের অস্ত্রোপচার করতে চিকিৎসক বাধ্য হয়েছিলেন, সেই ঘটনা আবারও ঘটতে পারে। তখন আমরা সেই মাকে স্বাভাবিকভাবে প্রসবের জন্য আর বলি না।
আর যদি এমন হয় যে তখন প্রসব বেদনা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে গিয়ে প্রসবটি আটকে যাওয়ার কারণে হয়তো স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে আবার স্বাভাবিক প্রসব হতেও পারে। তবে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ হবে, যদি সঙ্গে চিকিৎসক উপস্থিত না থাকে কিংবা যদি সেটি হাসপাতাল না হয়, তাহলে ব্যাপারটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আর কোনো মায়ের যদি দুবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব হয়ে থাকে, তাহলে পরেরবার অবশ্যই সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করতে হবে।
প্রশ্ন : প্রসব বেদনার ধরন কেমন হবে? একজন মা কী ধরনের ব্যথা উঠলে বুঝতে পারবেন এখন তাঁর সন্তান হওয়ার সময় হয়েছে?
উত্তর : প্রসব বেদনা একটি ছন্দময় বেদনা। এটি কিছুক্ষণ পরপর ওঠে। তীব্রতা বাড়ে এবং স্থায়িত্ব বাড়ে। দেখা গেল প্রথমে দুই ঘণ্টা পর পর ব্যথাটা উঠত। থাকত ১০ সেকেন্ড, তারপর এক ঘণ্টা পরপর ওঠে, থাকে ২০ সেকেন্ড, এভাবে তীব্রতা বাড়ে। স্থায়িত্ব বাড়ে। ব্যথাটি তলপেটে যায়, কোমরে যায়, দুই পায়ের মাঝে যায় এবং জরায়ুতে মা চাপ অনুভব করে। এভাবে ব্যথার তীব্রতা এতই বাড়ে যে সে মায়ের আর বসে থাকা সম্ভব নয়; এবং কোনো ওষুধে সে ব্যথা থামবে না। এই ব্যথাকে আমরা বলি সত্যিকারের প্রসব বেদনা।