শিশু নির্যাতন
মানুষ অপরাধ কেন করে?

সম্প্রতি পত্রিকায় শিশু নির্যাতনের কথা ঘনঘনই পড়তে হচ্ছে। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি শিশু হত্যাকাণ্ডের কাহিনীও এসেছে। প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে, পত্রিকা পড়াই ছেড়ে দেব। তবুও দেখতে না চাইলেও চোখ চলে যায় এই খবরগুলোর ওপর। দু-একটি ঘটনায় মা শিশুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত, এমন ইঙ্গিত ছিল। পৃথিবী দুলে ওঠে এমন খবরগুলোতে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে এগুলো শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করার। মিডিয়াও জনমত তৈরি করে রাষ্ট্রকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে। আইন তার নিজস্ব গতিতে যাক। প্রশ্ন হলো, কেন এই ভয়াবহ অপরাধগুলো মানুষ করে? একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা যাক।
শিশু হত্যাকাণ্ড, যেকোনো হত্যাকাণ্ড বা যেকোনো অপরাধ মানুষ কেন করে? এর একটি বা দুটি নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অপরাধবিদদের মতে এর কারণগুলো হলো :
- যখন অপরাধ করে ধরা পড়ার ঝুঁকির চেয়ে অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সুবিধা বেশি হয়, তখন মানুষ এমন করে।
- যখন অপরাধের মাধ্যমে অন্যদের সুবিধা পেতে দেখে, তখন নিজেও অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়।
- কারো কারো মধ্যে অপরাধ করার একটা প্রবণতা থাকে। অর্থাৎ তার মধ্যে অপরাধ করার জন্য এক ধরনের জিনগত প্রস্তুতি নিয়েই তারা জন্মায়। পুরুষদের মধ্যে নারীদের তুলনায় আগ্রাসী আচরণ বেশি দেখা যায়। পুরুষদের মধ্যে আছে xy ক্রোমোজম, যেখানে নারীদের থাকে xx ক্রোমোজম। কিছু পুরুষের মধ্যে xyy ক্রোমোজম দেখা যায়। এদের মধ্যে অপরাধ করার হারও বেশি থাকে।
- মানুষের মস্তিষ্কে ‘সেরোটনিন’ নামে এক ধরনের নিউরোকেমিক্যালের ঘাটতি থাকলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
- কেউ যদি অনেক বেশি পরিমাণে ‘স্টেরয়েড’ শরীরে নেয়, তবে তার মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেড়ে যেতে পারে।
- মস্তিষ্কের কোনো অসুখ, যেমন—টিউমার, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অপারেশনের সময়ে সৃষ্ট ক্ষতি ইত্যাদি কারণে মস্তিষ্কের আক্রমণাত্মক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণকারী অংশের ক্ষতি হলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বদলে যেতে পারে এবং সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
- শৈশবে যারা ভালোবাসা পায় না, নির্যাতন ও ঘৃণার মধ্যে, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের মধ্যে, বাস্তব ঝুঁকির মধ্যে যারা বেড়ে ওঠে; তাদের কারো কারো মধ্যে এই প্রবণতা থাকে।
- যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে সে যতই চেষ্টা করুক, তার আর্থিক অবস্থা উন্নতি করা একদম সম্ভব নয়, অথচ সে খুবই বঞ্চিত, তখন তার মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা বাড়তে পারে। সমাজ সম্পদশালীদের মূল্যায়ন করে। দরিদ্র সম্পদ পাওয়ার আশায় অপরাধ করে। সম্পদশালী আরো সম্পদের আশায় অপরাধ করে। তবে সম্পদশালীর তুলনায় দরিদ্ররা বেশি ধরা পড়ে। কারণ, সমাজ সম্পদশালীদের পক্ষে।
- সমাজে যখন অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, যখন নৈতিকতার অবক্ষয় হয়, তখন এই সমাজের সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কোনটি নীতি, কোনটি নীতি নয় সেই ধারণা পরিষ্কার না থাকলে সমস্যা তৈরি হয়। ধর্ম আমাদের নৈতিকতা শেখায়। সমাজ নৈতিকতা রক্ষা করতে উৎসাহিত করে।
- যাদের বাবা-মা বা ঘনিষ্ঠ যত্নগ্রহণকারী অপরাধী, তাদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। কেননা, শিশু তার ঘনিষ্ঠজনকে দেখেই শিখে। যাদের বাবা–মা মাদক ব্যবহারকারী, তাদের মধ্যেও এমনটা হতে দেখা যায়।
- যেসব পরিবারে নৈতিকতাকে মূল্যায়ন করা হয় না, অনৈতিক কাজের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আছে—সেসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি থাকে।
- যেসব পরিবার কোনো কারণে একজন মাত্র অভিভাবক দিয়ে চালিত হচ্ছে, সেখানে শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়। যদি কোনো কারণে বাবা-মা দুজনই থাকেন, কিন্তু শিশুর প্রতি ভালোভাবে লক্ষ রাখতে না পারেন, তবেও এই ঝুঁকি বাড়ে। যদি কোনো কারণে শিশুর অন্যায় আচরণগুলো পুরস্কৃত হয়, তবে সে এই ধরনের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ও অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
- যেসব শিশু-কিশোর অপরাধপ্রবণ শিশু-কিশোরদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে, তারাও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের দলে অপরাধ করার প্রতি এক ধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেখা যায়।
- ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র এলাকা, একসঙ্গে গাদাগাদি করে যেখানে অনেক মানুষ থাকে, সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়।
- একবার যখন কোনো কারণবশত কেউ অপরাধ করে ফেলে, কোনো না কোনো কারণে ‘অপরাধী’ হিসেবে পরিচিত পায়, তখন তার মানবিক অধিকার গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়। রাষ্ট্র, সমাজ বা ধর্ম আর তাকে রক্ষা করে না। তখন তার জন্য আরো অপরাধ করাই সহজ হয় এবং অপরাধীদের সমাজে (সমাজের মধ্যে ক্ষুদ্র ও অচ্ছুত সমাজ) মেশাই তার জন্য সহজ হয়। সে আরো অপরাধ করে ধীরে ধীরে পাকা অপরাধী হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো চরিত্রহীন কোনো আচরণে জড়িয়ে গেল। এখন চরিত্রহীনতা ছাড়া আর গতি নেই। পরিবার সরে গেছে। বাঁচতে তো হবে।
- কোনো কোনো শিশু-কিশোরের মধ্যে অপরাধ করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। তারা অন্যদের মারে, মিথ্যা কথা বলে, চুরি করে, পশু-পাখির প্রতি নির্দয় হয়, অন্য শিশুদের যৌন নির্যাতন করে, অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি করে, স্কুল পালায়, পড়তে চায় না। অনেকে ধীরে ধীরে ছোট-বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
- মাদক ব্যবহারকারী, অ্যান্টিসোশ্যাল ও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার ধরনের মানসিক রোগে যারা ভুগছে, তাদের মধ্যে অপরাধের ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। যারা গুরুতর ব্যক্তিত্বের রোগে ভোগে, তাদের চিন্তাধারা, তাদের প্রতিক্রিয়া একদম অন্য রকম। তারা পৃথিবীটা নিজের মনে করে। অন্যেরও যেকোনো অনুভূতি থাকতে পারে, তারাও যে দুঃখ-কষ্ট পেতে পারে সেই অনুভূতি তার থাকে না। অনেকের, এমনকি নিজের প্রতিও মায়া থাকে না। অন্যের প্রতি মায়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তারা ভাবতে পারে, ‘আমাকে যেহেতু রাগিয়ে দিয়েছ বাছাধন, এখন তার ফল ভোগ করো’, ‘আমি যদি এখনই ওকে উপযুক্ত শাস্তি না দিই, তবে ও আমার মাথায় উঠে বসবে’, ‘ওর জন্য এটাই পাওনা’ ইত্যাদি। ব্যক্তিত্বের রোগীদের অনেকে খুব ঝোঁকের বশে চলে। মনে হলো আর কিছু একটা করে বসল। একদম নিজের প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়। কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
- অনেক সময় বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষগুলো আত্মহত্যা করে। আবার কেউ কেউ পরিবারের ঘনিষ্ঠজনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। এক ধরনের নেতিবাচক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই তারা এটা করে। তারা ভাবতে পারে, ‘আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে আার পারছি না। মৃত্যুই আমার মুক্তির উপায়। আমার অবর্তমানে আমার সন্তান অনেক কষ্ট পাবে। তাই ওকেও নিয়ে যাই।’
যখন অপরাধ সংগঠিত হয়, তখন দুর্বলরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দরিদ্র অসহায় মানুষ, নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অপরাধীদের অপরাধ অনুপাতে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের ভাবার দরকার, কেন অপরাধ হয়। কেন অপরাধ হয়, তার মধ্যেই নিহিত আছে অপরাধ প্রতিরোধের উপায়গুলো। সভ্য মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই, ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের সবারই দায়িত্ব হলো অপরাধ প্রতিরোধ করা। ভালোভাবে, সমন্বিতভাবে চেষ্টা করে অপরাধের কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করলে অপরাধ অনেক কমে আসবে। শিশু হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের কলঙ্ক থেকে জাতি হিসেবে আমরা মুক্ত হতে পারব। অপরাধমুক্ত সমাজ হোক, সেই প্রত্যাশাই আমাদের।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।