মানসিক রোগ নিয়ে যেসব ভ্রান্ত ধারণা হয়

মানসিক রোগ নিয়ে অনেক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪৯৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. কামরুজ্জামান মজুমদার। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : এই যে মানসিক রোগ। একে আমরা মানসিক রোগ বলি, কেউ পাগল হওয়া বলেন, কেউ নানা রকম নামে ডেকে থাকেন। মানসিক রোগ সম্পর্কে আমাদের সমাজে কী কী ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।
উত্তর : আসলে যেখানে অজ্ঞতা সেখানে তো ভুল ধারণা থাকে। মানসিক রোগ সম্পর্কে বেশি মানুষ জানে না। এমনকি শিক্ষিত মানুষ যারা, যারা ভাবেন আমি অনেক পড়াশোনা করেছি, তারাও কিন্তু মানসিক রোগ সম্পর্কে অনেক ধারণা রাখেন না। খুব প্রচলিত কিছু ধারণা ছিল, পূর্ব ধারণা, যেটা এখনো আছে যে মানসিক রোগ হলো জিন-ভূতের আছর বা কোনো পাপ কাজ করলে এগুলো হয়। পাশাপাশি কিছু আধুনিক ধারণাও যোগ হয়েছে, যেটা আগেও ছিল, এখনো আরো বাড়ছে। যেমন মানসিক রোগ হলে আর ভালো হয় না কখনো। মানসিক রোগ হলে ওষুধ না খাইয়ে রোগীকে ওভাবে রেখে দেওয়াটা হয়তো ভালো। এ রকম প্রচুর ভুল ধারণা আছে। কিছু ধারণা আছে যারা মানসিক রোগের চিকিৎসা করে তারাও মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত হয়। বিষয়গুলো কিন্তু মানুষ এখনো ভাবে।
প্রশ্ন : মানসিক রোগীদের পাগল বলা হয়। মানসিক রোগী মানে পাগল এটিও একটি ভুল ধারণা?
উত্তর : পাগল বলতে সাধারণ মানুষ যেটি মনে করে তাদের সেন্সের ঠিক নেই। তাদের বিচার-বিশ্লেষণক্ষমতা ঠিক নেই। তারা ভুল দেখছে বা ভুল ভাবছে। ভুল একটি জায়গা যেখানে একটি মানুষ উদভ্রান্ত। তার নিজের সম্বন্ধে সচেতন নয়। কিন্তু মানসিক রোগ বিষয়টি এত সহজ নয়। অনেকগুলো ধারাবাহিক ধাপ আছে। এটা যদি সর্বোচ্চ ধরা হয় যে একটি মানুষের স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে এবং সে ঠিকমতো দেখতে পারছে না। বুঝতে পারছে না কোনো কিছু। তার পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে ধারণা নষ্ট হয়ে গেছে। তার আগে অনেকগুলো ধাপ আছে। যেমন আমরা যদি বলি প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে দুঃখ কষ্ট তো থাকেই। এটা হচ্ছে মানসিক একটি অসুবিধা।
মনের সমস্যা, মনের কষ্ট। এটার আসলে কোনো চিকিৎসা লাগে না। এমনি এমনি সেরে যায়, কারো সাহায্য পেলে আরেকটু ভালো হয়। এর চাইতে আরেকটু বেশি কী হতে পারে? এই কষ্টটা এমন যে অনেক দিন ধরে আছে তার মধ্যে। তখন হয়তো কারো সাহায্য লাগবে। আরেকটু বেশি কী হতে পারে? তার কষ্টটা এমন যে তার বিচার-বিশ্লেষণ ঠিক আছে, তবে সে এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। তখন প্রফেশনাল সহায়তা লাগে। যেমন হয়তো একজন কাউন্সেলিং করলেন। আরেকটু জটিল হলে তখন সাইকোথেরাপি বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির সার্ভিস লাগতে পারে। আরেকটু জটিল হলে যেখানে ব্যক্তির বিচার বুদ্ধি বা বোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সাইকিয়াট্রিক মেডিকেশনের দরকার হতে পারে।
কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো থাকলে আমরা বলি মানসিক রোগ। নয়তো মানসিক রোগ বলি না। মানসিক রোগ হতে হলে তার এমন কিছু আচরণ হতে হবে, যেটা সাধারণত মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। তার আচরণগুলো হয়তো সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তবে সাধারণ মানুষ যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে সেটি করে, সেটি সে করছে না। যেমন আমরা দুঃখের কথা বললে কাঁদি, হাসির কথা হলে হাসি। কেউ যদি দুঃখের কথা হলে হাসতে থাকে, হাসির কথা হলে কাঁদতে থাকে, ধরেন কেউ মারা গেছে মিলাদ অনুষ্ঠান, সেখানে খুব সাজগোজ করে গেছে। ওই পরিস্থিতিতে এই আচারণটি ঠিক মেলে না। এগুলো হলো মানসিক সমস্যার লক্ষণ। আবার আরেকটি দিক হচ্ছে মানসিক রোগের বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যক্তির মধ্যে অসুবিধা তৈরি করে।
আমরা প্রায়ই বলি, যেটি খুব ভুল ধারণা শিশু ও পাগল এদের কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। তবে যদি পাগল বলি যাদের তীব্র মানসিক কষ্ট, তারা বোঝে, আর আমরা কিছুটা বুঝি। কারণ তারা আমাদের কাছে এসে বলে। মানসিক রোগীরা যে আত্মহত্যা করে এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে। তার মনের মধ্যে কেউ একজন বলছে ওকে খুন করো। সেটা সে চায় না। তখন সে হয়তো নিজেই আত্মহত্যা করে বসে। তার কিন্তু চাপ হয়, মানসিক রোগ হলে। আরেকটি জায়গা হলো, তার কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হবে। আমার মন খারাপ হলেও সেটি নিয়ে আমরা কাজকর্ম করতে পারি। তবে মন খারাপ যদি এমন পর্যায়ে হয়, যে আমি কাজকর্ম করতে পারছি না, তখন এই ক্ষেত্রে কারো সহায়তা লাগবে। মানসিক অসুবিধা তার হয়েছে, তার সাহায্য লাগবে।
প্রশ্ন : মানসিক সমস্যা একটি বিষয়। আরেকটি হলো মানসিক রোগ। মানসিক সমস্যা হলে তার কাউন্সিলের কাছে যাওয়া, অন্যের সাহায্য নেওয়া, সেটি করা যেতেই পারে এবং এর উত্তরণ সহজ হয়, তবে আমাদের সমাজে যেটা হয়, এটিও হয়তো একটি ভুল ধারণা আমি কেন মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে যাব? আমি তো মানসিক রোগী নই।
উত্তর : সবচেয়ে বড় কথা আমি দেখি যে প্রাথমিক অবস্থায় যদি কেউ সাহায্যের জন্য আসে আমাদের কাছে, তাকে যত সহজে সাহায্য করা যায়। সমস্যাটা তীব্র হয়ে গেলে, তখন এর আরো অনেকগুলো দিক তৈরি হয়।
মানুষ আমাদের কাছে না আসার একটি ধারণা হলো সেটি যে আমি কেন যাব? আরেকটি বিষয় হলো মানসিক সমস্যা নিয়ে কিছু অপবাদ আছে, যে যদি কাউকে বলে যে আমি মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছ গিয়েছিলাম, এর মানে সে তো মানসিক রোগী। তাহলে তার পরিবারে হয়তো এটি আছে, তার বিয়ে হবে না। আমার মেয়েকে আমি বিয়ে দেব কীভাবে? এগুলো নিয়ে তারা ভাবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজেও লোকটিকে নিতে গেলে ভাবে লোকটি পারবে কি না। পরিবার কিন্তু অনেক সময় ভাবে যে তাকে কাজকর্ম না দেওয়াই ভালো। কাজকর্ম করলে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় যে আমি পারি। এটি তাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। আশা জাগায় তার মধ্যে। আর আমি যদি বসে থাকি, তাহলে কী হবে, আত্মবিশ্বাস আসবে না। আমি পারবই না। এই জিনিসগুলো আসে।
প্রশ্ন : আরেকটি ভুল ধারণার বিষয়ে আপনি বলছিলেন, যে জিনে ধরা, ভূতে ধরা, নানা রকম আচরণগত যেই সমস্যা, মূলত এটি মানসিক রোগ। তবে আমাদের সমাজে এখনো এটি বদ্ধমূল ধারণা আছে যে এটা অন্য কিছুর আছর। তাতে করে নানা রকম পীর ফকির পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ, এগুলো দেয়। এখানে কখনো কখনো ভালো হয় এ রকমও অ্যাপেয়ার করে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী।
উত্তর : এই ক্ষেত্রে দুটো জিনিস রয়েছে। কিছু কিছু মানসিক সমস্যা আছে যেগুলো দ্রুত এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। আবার কিছু কিছু সমস্যা আছে এভাবে ভালো হয় না। যখন একটি মানুষ ভুল চিকিৎসার শিকার হয়, তার জীবনটা আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। একটি মানুষ যখন মানসিকভাবে বিরক্ত থাকে, তার কষ্টটা ভীষণ কষ্টকর। তার কষ্টটা কাউকে বোঝাতেও পারে না এমন অবস্থা। তাকে যখন নির্যাতন করা হয়, ভুল চিকিৎসা করা হয়, তার সমস্যা তো ভালো হয়ই না। তার জটিলতা আরো বাড়তে থাকে। আমরা যেটা বলি তাকে যতদূর সম্ভব মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসার দরকার। বাংলাদেশেও কিন্তু এখন মানসিক রোগের চিকিৎসার প্রায় যতগুলো ধাপ আছে, প্রায় সবগুলো আমাদের দেশে এখন আছে। যেমন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে আমাদের দেশে। যথেষ্ট সংখ্যক। দ্বিতীয় ধাপটা যদি বলি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলর আছে আমাদের দেশে। ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্ক বলে একটি ধারণা আছে, সামাজিকভাবে তাদের সাহায্য করা সেই জায়গাটাও আমাদের আছে। বেশ কিছু মানুষ রয়েছে যারা হয়তো প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সিলর নয়, তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্যদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছে। সুতরাং আমরা বলব যত দ্রুত সম্ভব আপনারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
প্রশ্ন : আপনি বললেন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে, কাউন্সিলর আছে, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট আছে। তাহলে কী ধরনের বা কোন পর্যায়ের সমস্যা হলে, কার কাছে যাবেন? এবং তার কখন শুধু কাউন্সেলিংয়ে হবে, কখন তার সাইকোথেরাপি লাগবে, কখন তার মেডিকেশন লাগবে? এটিও একটি ধারণা রয়েছে মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে গেলে তারা কাউন্সেলিং না করে কেবল ওষুধ দেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
উত্তর : ওষুধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিশাল একটি ভুল ধারণা এবং ভয় আছে। ওষুধ খেলে ক্ষতি হবে। অবশ্যই ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমাদের কিন্তু দেখতে হয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটুকু? আর আমাদের কাজের জিনিস কতটুকু? আমি যদি কিছু কিনতে যাই ফ্রিতে তো কেউ দেবে না। টাকা দিতে হবে। আমি যদি রোগ ভালো করতে যাই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো মেনে নিতে হবে আমার। এখনকার ওষুধগুলো কিন্তু অনেক আধুনিক। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। তবে যেটা বলছিলেন, কখন কোথায় যাবে মানুষের জন্য নির্ধারণ করা খুব কঠিন আসলে। আমরা বলব আপনার এত চিন্তা করার দরকার নেই। আপনি যেকোনো একজনের কাছে যান, উনি আপনাকে বলে দেবেন, এর বাইরে আপনার কারো কাছে যেতে হবে কি না।
আমরা সাধারণত বলি যখন একটি মানুষের সমস্যাটা এই ধরনের যে খুব মন খারাপ, এটা খুব একটা তীব্র নয়, কিন্তু সে অনুভব করছে আমার কারো সঙ্গে কথা বলা দরকার, তখন কাউন্সিলরের কাছে যেতে পারেন। কাউন্সেলিং মূলত তীব্র সমস্যায় নয়, খুব সামান্য সমস্যায় কাজ করে, তবে সাহায্য করতে পারে। যদি সমস্যাটা এমন হয় যে এটা এতই তীব্র যে এটা নিয়ে কাজ করতে সে পারছে না, বা এটা নিয়ে তার তীব্র মাত্রায় অসুবিধা হচ্ছে, তার কাজকর্ম সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন আমরা বলি সাইকোথেরাপির জন্য আসা। যেখানে তাকে সাইকোলজিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করে তার সমস্যা যেটা হয়ে গেছে বা ডিজঅর্ডার যেটা আছে, সেটা যদি সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে তখনই যাবে, যখন সমস্যাটা এতই তীব্র যে ব্যক্তি আর কিছুই করতে পারছে না। অনেক সময় ব্যক্তি হয়তো বুঝতে পারে না আমি কোথায় আছি, কী করছি? তখন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে। তা ছাড়া ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে যখন মানুষ যায়, হয়তো একটা ছেলে সে পরীক্ষা নিয়ে ভয় পাচ্ছে, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে গেলে সাইকোথেরাপি উনি দেবেন, কাউন্সিলর ওখানে সাহায্য করতে পারে। সাইকিয়াট্রিস্টও ওখানে সাহায্য করতে পারে। যদিও তার সমস্যাটি অত তীব্র নয়। সাইকিয়াট্রিস্টের একটি সুবিধা হলো ওষুধটা খেলে উদ্বেগ কিন্তু আপনাআপনি চলে যায়। পরীক্ষার আগে সে হয়তো ওষুধ খেল তার ঘুমের হয়তো একটু অসুবিধা হলো, তবে পরীক্ষার আগে তার দুশ্চিন্তা চলে যাবে। পরীক্ষা সে ভালোমতো দিতে পারবে। তবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও কাউন্সেলিং অত দ্রুত কাজ করবে না। সাইকোথেরাপির চিকিৎসা দিতে গেলে একটি লম্বা সময়ের চিকিৎসা আছে। আমরা বলি প্রায় দুই থেকে আড়াই মাসের মতো একটি সময় লাগে। আর সাইকিয়াট্রিস্টের সুবিধা হলো খুব দ্রুত কাজ করেন।