টনসিল ও এডিনয়েডের সমস্যায় করণীয়

শিশু ও বড়দের ক্ষেত্রে টনসিল ও এডিনয়েড বা নাকের ভেতর একটি টিস্যুর সমস্যা বেশ প্রচলিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে রোগটি জটিল হয়ে উঠতে পারে। আজ ১২ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৩৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান গলা বিভাগের হেড নেক সার্জারি ইউনিটের প্রধান পরামর্শক ডা. সৈয়দা শারমিন জামাল।
প্রশ্ন : টনসিল এবং এডিনয়েডের সমস্যা কেন হয়?
উত্তর : টনসিল বাচ্চাদের এবং বড়দের বেলায় খুব প্রচলিত একটি শব্দ। আমাদের মুখ গহ্বরের পেছনে, জিহ্বার পেছনের দিকে লাল মাংস পিণ্ডের মতো দেখা যায়। যেটাকে আমরা টনসিল বলে থাকি। এটি একটি লিম্ফোয়েড টিস্যু। এটি যখন লাল হয়ে, ফুলে প্রদাহ সৃষ্টি করে, ইনফেকশন হয়, তখন সেটাকে আমরা টনসিলাইটিস বলে থাকি।urgentPhoto
প্রশ্ন : আসলে আমার মনে হয়, অনেকেই টনসিলের সঙ্গে পরিচিত আছেন। কিন্তু এই যে এডিনয়েড বলে একটি জিনিস যুক্ত হলো সেটি আসলে কী? এর অবস্থান কোথায়?
উত্তর : আসলে এডিনয়েডও টনসিলের মতো একটি লিম্ফোয়েড পেচি টিস্যু। এটি আমাদের নাকের পেছনে, বিশেষ করে নাকের পথের পেছন দিকে অবস্থান করে। এটা সাধারণত বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায় এবং এটি বড় অবস্থায় থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা ছোট হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু বাচ্চাদের এটা টনসিলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাই দেখা যায় ঠাণ্ডা, কাশি, সর্দি ধরনের বিষয় হয়ে প্রথমে টনসিলটা আক্রান্ত হয়। তখন যদি শিশুটি গলা ব্যথা বলে এবং সময়মতো যদি এর চিকিৎসা না করা হয় তখন এডিনয়েডটাও আক্রান্ত হয়ে যায়। তাই একে আমরা এডিনয়েড টনসিলাইটিস বলে থাকি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে।
টনসিলটা ছোটদের বেশি হলেও বড়দেরও হয়। তবে এডিনয়েডটা সাধারণত ছোটদেরই বেশি প্রভাবিত করে। তিন, সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত এটা বেশ ভালোই ভোগায়। অনেক মা-বাবাই এই সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। যখন পাঁচ বছরের কাছে চলে যায় তখন এর আয়তনটা ছোট হয়ে যায়। সাধারণত ১০ বছরের মধ্যেই এটা ছোট হয়ে যায়। তখন এটার সমস্যাটা কমে যায়।
টনসিলে যেমন গলা ব্যথার সমস্যার নিয়ে আসে তেমনি এডিনয়েড যেহেতু নাকের পেছনে অবস্থান করে তখন প্রথমেই যেই সমস্যার কথাটা বলে সেটা হচ্ছে বাচ্চাটা মুখ হা করে ঘুমায়। সে নাক ডাকে বা ঘুমাতে গেলে নাক ডাকার মতো একটা শব্দ হয়, লালা পড়ে। আস্তে আস্তে দাঁতগুলো একটু উঁচু হয়ে যায়, যেটা হয়তো আগে ছিল না। যাঁরা সচেতন মা-বাবা তাঁরা হয়তো খেয়াল করেন বিষয়টি। আরেকটু যদি দেরি হয়ে যায় তখন অনেক সময় কানে শোনার সমস্যা নিয়েও আসে। কানে একটু ব্যথার মতোও হয়।
প্রশ্ন : সমস্যাটি গলার দিকে কিন্তু উপসর্গগুলো কানে গিয়েও হতে পারে। সেটি কেন হচ্ছে?
উত্তর : এডিনয়েডটা যখন সংক্রমণ বা প্রদাহজনিত কারণে ফুলে যায়, তখন আমাদের নাকের পেছনের দুই পাশেই, এডিনয়েডের পেছনের দুই পাশে, নাকের সঙ্গে কানের যোগাযোগের জন্য যে পাইপ বা নালী থাকে, এতে সমস্যা হয়। আর এই টিউবটা খোলা হয় আমাদের কানের পর্দার পেছনে। যেখানে ফ্লুইডগুলো জমা হতে থাকে। প্রাথমিকভাবে শুরুর দিকে এর চিকিৎসা করলে সমাধান সম্ভব। তখন অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিহিসটামিন ওষুধ দিলে বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে সমস্যাটি ভালো হয়ে যায়। তবে যদি দেরি করে ফেলে শিশুটির কানের সমস্যা হয়ে যায়।
অনেক সময় দেখা যায় শিশুটি কানের সমস্যা নিয়ে এসেছে কিন্তু আসলে তার এডিনয়েডের সমস্যা হয়েছে।
প্রশ্ন : বাচ্চারা যে শুনতে পারছে না এটি মা-বাবারা কীভাবে বুঝবে?
উত্তর : একটি সমস্যার কথা তো বেশ বলে যে বাচ্চার কানে ব্যথা হচ্ছে। আর অনেক সময় শিক্ষক হয়তো মা-বাবাকে বলে আপনার বাচ্চাটি মনোযোগী না। শ্রেণীকক্ষে ঠিকমতো সাড়া দেয় না। মা-বাবারাও হয়তো দেখে শিশুটিকে হয়তো ডাকছে, কিন্তু সে হয়তো মনোযোগী হচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবারা চিন্তিত হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আসেন।
তবে এর প্রতিরোধ সম্ভব যদি আগে থেকেই এর চিকিৎসা করা হয়। যদি মা-বাবারা কম-বেশি খেয়াল করেন।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের আগে আমি একটু জানতে চাইব এর চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে। যদি এর সঠিক সময় আসে তখন কোন ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে সেটি নির্ভর করে ঠিক কোন জিনিসটির ওপর?
উত্তর : এটি সাধারণত বাচ্চাদের উপসর্গগুলোর ওপর নির্ভর করে। যেমন প্রথমে সাধারণ এডিনয়েড বছরে একবার, দু’বার হয়তো আক্রান্ত হতেই পারে। সেই ক্ষেত্রে বাবা মায়েরা নিয়ে আসলে আমরা হয়তো সাধারণ চিকিৎসা দিই। সাত দিন বা ১০ দিনের একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিহিসটামিন কোর্স দেই বা একটু গরম পানির ভাপ নিতে বলি। এটি বাচ্চা হয়তো কম পারলেও তার আরাম বোধ হয়। প্রাথমিক চিকিৎসায় তখন ভালো হওয়া সম্ভব।
তবে যখন একটু দেরি হয়ে যায় তখন এক্সরে বা কানের শোনার পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় বেশি খারাপ অবস্থা তখন অস্ত্রোপচারে যাই। তবে সেটা অনেক পরে। কেননা এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসাই আছে যা প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে টনসিলাইটিস বা এডিনয়েড টনসিলাইটিস জন্য ভালো। তাই চিকিৎসকের কাছে গেলেই এটি ভালো হয়ে যাওয়া সম্ভব। তখন এতো জটিলতার দিকে হয়তো নাও যেতে পারে বাচ্চা, যদি মা-বাবারা একটু সচেতন হয়।
প্রশ্ন : কী ধরনেরর পরামর্শগুলো আপনারা মা-বাবাদের দেন, যেন এই সমস্যাগুলো বার বার না হয় বাচ্চার?
উত্তর : বছরে একবার কি দুইবার গলা ব্যথাকে আমরা সাধারণভাবে নিই। তবে গলা ব্যথা যদি বারে বারে হয় তখন একটু সচেতন হতে হবে। আর যখন ঠাণ্ডাটা লেগেই যায় সে হয়তো খেতে চাইবে না, একটু জ্বর জ্বর ভাব থাকবে, ১০০ বা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট যখন হয় তখন বাচ্চারা স্বাভাবিক কাজ থেকে সরে আসে। গলা ব্যথার জন্য সে খেতে চায় না। নাক বন্ধের জন্য ঘুমাতে পারে না। এই উপসর্গগুলো দেখলে যেন মা-বাবারা বাচ্চাকে ঠাণ্ডা খাওয়া কমিয়ে দেন, আইসক্রিম খাওয়া থেকে বিরত করেন। ঘাম মুছে দেন বার বার- এসব জিনিস একটু করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এগুলো হলে যেন সময়মতো চিকিৎসা করা হয়। নিজেরা না বুঝলে একটু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পেডিয়াট্রিকরাও অনেক সাহায্য করে। প্রাথমিক চিকিৎসা তারা দিয়ে দেয়। তারা যেই পরামর্শগুলো দেবে সেটা অবশ্যই মানতে হবে।
তবে বড়দের ক্ষেত্রে যেটা হয়, বছরে যদি তিন থেকে চার বারের বেশি সংক্রমণ নিয়ে আসে সেই ক্ষেত্রে কেবল আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ছেড়ে দেই না। কেননা এটি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। সেই ক্ষেত্রে টনসিলটা সার্জারি করা হয়। টনসিলকে প্রাথমিক রক্ষক হিসেবে ধরা হয়। তবে টনসিল যখন নিজেই অসুস্থ হয়ে যায়। তখন আর রক্ষক হিসেবে কাজ করে না। সমস্যাই তৈরি করে।