বিশ্ব মশা দিবস
ডেঙ্গু প্রতিরোধে চাই সমন্বিত টেকসই পরিকল্পনা

আজ বুধবার (২০ আগস্ট) বিশ্ব মশা দিবস। ১৮৯৭ সালের এই দিনে ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেছিলেন যে স্ত্রী অ্যানোফিলিস (Anopheles) মশাই ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। সেই আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি ছোট্ট মশা মানবজাতির জন্য কত বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
আজও মশাই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী জীব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় সাত লাখেরও বেশি মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকা এবং ইয়েলো ফিভার উল্লেখযোগ্য। শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই বৈশ্বিকভাবে ১৪ মিলিয়নের বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ রেকর্ড হয়েছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকারি তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশে প্রায় তিন লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১,৭০৫ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মহামারির প্রভাব অনেক বেশি। এর পেছনে নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসচেতনতার অভাব বিশেষভাবে দায়ী। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো এডিস মশার মধ্যে কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে প্রচলিত নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি কমাতে শুধুমাত্র ওষুধ ছিটানো বা ফগিং যথেষ্ট নয়। কার্যকর সমাধানের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা (Integrated Vector Management, IVM) । পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, জনগণকে সম্পৃক্ত করা, কীটনাশক সঠিকভাবে ব্যবহার করা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে জোর দেওয়া, এবং মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন জোরদার করা।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা মশার প্রজনস্থল শনাক্তকরণ, সঠিক পদ্ধতি ও অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারে দক্ষ হয়। এ ছাড়া, যোগ্য কীটতত্ত্ববিদ ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কন্ট্রোল প্রোগ্রাম তৈরি এবং নীতি নির্ধারণে পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশা নিয়ন্ত্রণ শাখাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান একত্রে উদ্যোগ নিলে কার্যকর ফলাফল আসবে। জনগণকে সচেতন করতে সামাজিক প্রচারণা, স্কুল ও কমিউনিটি শিক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং নিয়মিত মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন চালানো অপরিহার্য।
জলবায়ু পরিবর্তন মশাবাহিত রোগের বিস্তারে নতুন মাত্রা যোগ করছে। উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধির ফলে মশার প্রজনন ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামী কয়েক দশকে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে আচ্ছাদিত করতে পারে।
অতএব, বিশ্ব মশা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—মশার বিরুদ্ধে কেবল প্রতিকার নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই এবং বৈজ্ঞানিক সমর্থিত সমাধান তৈরি করা। মশা ছোট, কিন্তু ক্ষতি মহামারি-স্বরূপ। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণকে নিরাপদ রাখা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখা।
লেখক: কীটতত্ত্ববিদ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)