যুদ্ধকালীন সংকট থেকে এল ক্ল্যাসিকোর রোমাঞ্চ, গল্পটা লা লিগার

যদি ফুটবল দেখে থাকেন, পোকা হয়ে থাকেন খেলাটির, ক্লাব ফুটবল থাকে নখদর্পনে– ‘লা লিগা’কে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ইউরোপিয়ান নাইটগুলোতে লা লিগায় বুঁদ হয়ে থাকে আপামর ফুটবলপ্রেমী। হালফিলের লামিনে ইয়ামাল-কিলিয়ান এমবাপ্পেরা যতটা আলো ছড়াচ্ছেন, লা লিগা তারচেয়ে বহু বহু গুণ বড়। রথী-মহারথীদের কাছে লিগটির আবেদন কতটা, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।
স্পেনে ফুটবল বহু আগে থেকে জনপ্রিয়। কিন্তু জনপ্রিয় এই খেলার ছিল না শক্ত কোনো কাঠামো, ছিল না কেন্দ্রীয় কোনো লিগ। বিশের দশকে পরিবর্তনের বাতাস ছুঁয়ে যায় স্প্যানিশ ফুটবলে। উন্মোচিত হয় এক নতুন দিগন্তের। আঞ্চলিক দলগুলো নিয়ে চালু হয় নতুন এক ফুটবল লিগ। সদ্য শুরু হওয়া সেই লিগ নিয়ে দেশের বাইরে ছিল না কোনো আলোচনা। সময়ের পরিক্রমায় আজ সেই লিগই ফুটবলামোদীদের আলোচনার টেবিলে নিত্যদিনের টপিক। স্পেনের ছোট এক লিগ থেকে এখন উয়েফার র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় সেরা লিগের তকমা লা লিগার গায়ে।
লা লিগার গল্প এতটা সহজ ছিল না। ১৯২৯ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় স্পেনে একটি লিগ আয়োজনের। দশটি দলকে নিয়ে একাই বছর আয়োজন করা হয় প্রথম আসর। নাম দেওয়া হয়, ‘Campeonato Nacional de Liga de Primera División’ বা ‘জাতীয় প্রথম বিভাগ লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ।’। তবে, দর্শকের কাছে তখন থেকেই পরিচিত ছিল লা লিগা নামে। ১৯৮৪ সালে গঠন হয় লিগ পরিচালনা কমিটি। তখন অফিসিয়ালভাবে নাম দেওয়া হয় লা লিগা।
ফুটবল মাঠে যুদ্ধের ঝাঁঝ
সুবাস ছড়ানোর আগে ফুটবলের বাগানে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। সবুজ মাঠে লাগে গ্রেনেডের ঝাঁঝালো গন্ধ আর বোমার স্প্লিন্টারে শুরুতেই তছনছ হয়ে যায় সব। ১৯৩৬ সালে স্প্যানিশ সিভিল যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয় লিগ। তিন মৌসুম বন্ধ থাকে লিগ। এরপর চালু হলেও তৈরি হয় হাজার প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধের কারণে নষ্ট হয়ে যায় স্টেডিয়াম, মারা যান অনেক খেলোয়াড়, কেউ কেউ হন নির্বাসিত। আবার কেউ বিদেশ সফরে গিয়ে আর ফেরত আসেনি। আর্থিক সংকটও তীব্র হয়ে ওঠে ক্লাবগুলোর জন্য। ফুটবল মাঠে চলে রাজনৈতিক প্রচার। ব্যবহৃত হয় রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো ক্লাবগুলো। সীমিত করে দেওয়া হয় বিদেশি ফুটবলার দলে ভেড়ানো।
ফুটবল কাঠামোতে নতুন ছোঁয়া
যুদ্ধে যখন অন্ধকারে যাওয়ার পথে লা লিগার ভবিষ্যৎ, তখনই এগিয়ে আসেন স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, লুইস সুয়ারেজ মিরামন্তেস, এভারিস্তো দে মাসেদোরা। ১৯৫০-৭০ দশকে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয় লা লিগার। শুরুর ১০টি ক্লাব থেকে বেড়ে দল সংখ্যা হয় ২০টি। তখনও লা লিগা খুব একটা পরিচিত নয় বিশ্ব ফুটবলে। আশির দশকে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয় সেখানে। বিদেশি ফুটবলার দলে ভেড়ানোর সঙ্কট কিছুটা কমে যায়। কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। নিয়ম হয় ২-৩ জন বিদেশি ফুটবলার অংশ নিতে পারবে প্রতিটি দলে। সেই সময় ডিয়োগো ম্যারাডোনা, গ্যারি লিনেকার, হুগো সানচেজ, মাইকেল লড্রুপের মতো তারকারা যোগ দেন লা লিগায়। এতে ভিন্ন এক ডাইমেনশন তৈরি হয়।
তবে, একটি চারাকে যেমন ফুল ফুটিয়ে সুবাসিত করার পর্যায়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হয় দক্ষ মালির। তেমনি ১৯৮৪ সালে লা লিগার জন্য সেই মালি খোঁজার জন্য স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা হয়, নাম দেওয়া হয় Liga Nacional de Fútbol Profesional (LFP)। এলএফপপির প্রথম সভাপতি করা হয় আন্তোনিও বারোকে। এরপর ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের খেলোয়াড়দের জন্য কোটা উঠে যায়। বিশ্বসেরা তারকাদের গন্তব্য হয় লা লিগা।
লা লিগার বিশ্বায়ন
২০০৫ সালে মোটামুটি বিপ্লব ঘটে লা লিগায়। বিদেশি খেলোয়াড় দলে ভেড়াতে উঠে যায় আগের সব নিয়ম। উন্মুক্ত হয়ে যায় অন্যান্য মহাদেশের ফুটবলারদের দলে আনার পথ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এই সময়ে প্রায় সব মহাদেশ থেকে খেলোয়াড়রা স্পেনে আসতে শুরু করে। যার মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি এশিয়ার খেলোয়াড়ও ছিল। দলের স্কোয়াডগুলো হয়ে ওঠে বহুজাতিক। বিভিন্ন সময়ে জিনেদিন জিদান, লুইস ফিগো, রোনালদো নাজারিও, ডেভিড বেকহ্যাম, রবার্তো কার্লোস, মাইকেল ওয়েন থেকে সময়ের অন্যতম সেরা লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নেইমার জুনিয়রা এসে বদলে দেন পুরো লিগই। ফুটবল মাঠে তাদের গতি, পাসিং, টিকি-টাকা আর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য—সবই যেন একেকটি ইতিহাসের অধ্যায়। এই নামগুলোও জড়িয়ে আছে লা লিগার উত্থানের পেছনে।
গ্যালাক্টিকো যুগ আর এমএসএন ত্রয়ী
লা লিগার আলোচনায় রিয়াল মাদ্রিদের গ্যালাক্টিকো যুগ কিংবা বার্সেলোনার এমএসএন ত্রয়ীকে কি উপেক্ষা করার সুযোগ আছে? ২০০০ এর দশকে রিয়াল মাদ্রিদের গ্যালাক্টিকো যুগ কিংবা ২০১০-১১ মৌসুমে পেপ গার্দিওলার অধীনে বার্সেলোনার টিকিটাকা ফুটবল, ২০১৪-১৫ মৌসুমে মেসি-সুয়ারেজ-নেইমারদের ‘এমএসএন ত্রয়ীর’ সেই সাফল্যের সঙ্গে ফুটবলীয় শৈলি, লা লিগার উত্থানে কোনো কিছুকেই পিছিয়ে রাখার সুযোগ নেই। লা লিগার ইতিহাসের সেরা সময়গুলোর মধ্যে এগুলো ওপরের দিকে থাকবে।
দেপোর্তিভোর ঐতিহাসিক শিরোপা
একটু পেছন ফিরি। ষাটের দশক থেকে লা লিগায় আধিপত্য শুরু হয় রিয়ালের। বার্সেলোনা সেখানে যোগ দেয় আশির দশকে। তখন থেকেই বিদেশি খেলোয়াড় দলে ভেড়ায় তারা। কিন্তু ১৯৯৯–২০০০ মৌসুমে রিয়াল-বার্সার আধিপত্যের আভিজাত্য ভেঙে দিয়ে নতুন ইতহাস গড়ে দেপোর্তিভো লা করুনা। মধ্যম সারির দল হয়েও রিয়াল-বার্সাকে পেছনে ফেলে প্রথমবারের লিগ শিরোপা জিতে নেয় তারা। রয় মাকায়, ফ্রান, ডোনাটো, মাউরো সিলভা, বেবতোরা ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে এমন অসাধ্য সাধন করেন। লা লিগার ইতিহাসে যা “গোলাপি চমক” হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
দ্য ক্ল্যাসিক এল ক্ল্যাসিকো
লা লিগার আলোচনায় এল ক্ল্যাসিকো না থাকা লবন ছাড়া তরকারির মতো। স্প্যানিশ লিগের অবিচ্ছেদ্য অংশ রিয়াল-বার্সার দ্বৈরথের এই এই ম্যাচ। তবে, দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর এই লড়াইয়ের শুরুটা লা লিগা শুরুরও আগে। ১৯০২ সালে শুরু হয় রিয়াল-বার্সার এই লড়াই, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে লা লিগার মাধ্যমে। এল ক্ল্যাসিকো শুধু একটি ম্যাচ নয়। এটি একটি আবেগ, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইও বটে। রিয়াল মাদ্রিদকে দেখা হয় স্প্যানিশ রাজতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। আর বার্সেলোনা হয়ে উঠেছে কাতালান স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক পরিচয়ের প্রতীক। রিয়াল-বার্সার ম্যাচে অন্যরকম আবেগ ছুঁয়ে যায় দুই শহরের মানুষের মাঝে। যেটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ফুটবল বিশ্বে। শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই লড়াই, দুই ক্লাবের শিরোপা সংগ্রহ, বিশ্বসেরা ফুটবলারের আগমন, গ্যালাক্টিকো যুগ, মেসি-রোনালদো দ্বৈরথ—সবকিছু মিলে এল ক্ল্যাসিকো তর্কসাপেক্ষে এখন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচ।
লা লিগার আধিপত্য
১৯২৯ সালে শুরু হওয়া লা লিগার শুরুর চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। ১৯৩৬ সালে যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে মোট ছয়টি মৌসুম মাঠে গড়ায়। সেখানে লা লিগায় এখন আধিপত্য করা রিয়াল কিংবা বার্সা নয়, আধিপত্য ছিল অ্যাথলেতিকো বিলবাওয়ের। শুরুর সেই ছয় মৌসুমের পাঁচটি শিরোপা যায় তাদের ঘরে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রিয়াল-বার্সেলোনা। লিগে সর্বোচ্চ ৩৫ বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ। আর দ্বিতীয় সেরা ২৮ বারের চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনা।
লা লিগার বর্তমান অবস্থা
শুক্রবার (১৫ আগস্ট) থেকে শুরু হয়েছে লা লিগার নতুন মৌসুম। সর্নশেষ মৌসুমটা ভালো যায়নি রিয়ালের। মৌসুমের সবগুলো এল ক্ল্যাসিকো হেরেছে লস ব্লাঙ্কোরা। যে কারেণ নতুন মৌসুম নতুনভাবে শুরু করছে রিয়াল। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এক সময়ের রিয়াল।তারকা জাবি আলোনসোকে। দলেও এসেছে একাধিক পরবির্তন। অন্যদিকে, হ্যানসি ফ্লিকের অধীনে বড় পরিবর্তন ছাড়াই শিরোপার মিশনে নামছে বার্সা।
২৪ বছর পর এবার লা লিগায় ফিরেছে রিয়াল ওভিয়েদো। তাদের সঙ্গে শীর্ষ লিগে ফিরে এসেছে লেভান্তে ও এলচে। নতুন মৌসুমে বার্সার পরীক্ষিত দল, রিয়ালের নতুন শুরু কিংবা রিয়াল ওভিয়েদোর প্রত্যাবর্তন মিলিয়ে আবারও নতুন উন্মাদনায় বুঁদ হওয়ার পালা।