হাড় ক্ষয় হলে

অস্টিওপরোসিস বা হাড় ক্ষয় রোগ সাধারণত ৪০ বছরের পরে বেশি হয়ে থাকে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। আজ ৬ জুন এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২০৫৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ইউসুফ আলী।
প্রশ্ন : অস্টিওপরোসিস বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : অস্টিও মানে হাড়। আর পরোসিস মানে ছিদ্র হয়ে যাওয়া। হাড় যখন ছিদ্র হয়ে যায় তখন তাকে অস্টিওপরোসিস বলে। ছিদ্র হয়ে যাওয়া মানে নরম হয়ে যাওয়া। হাড়ের যে মিনারেল থাকে সেটি যখন কমে যায় তখন হাড়টা নরম হয়ে যায়। তখন এটাকে অস্টিওপরোসিস বলি। ছাঁকনির ভেতর যেমন ছোট ছোট ছিদ্র থাকে ঠিক এগুলোর মধ্যেও ছিদ্র হয়ে যায়, তখন তাকে অস্টিওপরোসিস বলে। বয়স যখন বাড়তে থাকে তখন অস্টিওপরোসিস হয় ক্যালসিয়ামের অভাবে।
হাড়ে সাধারণত দুটো কোষ থাকে। একটি হাড়কে তৈরি করে, আরেকটি হাড়কে ক্ষয় করে। যেটি তৈরি করে একে বলা হয় অস্টিওব্লাস্ট। আর যেটি ক্ষয় করে একে বলে অস্টিওক্লাস্ট। এ দুটোর যখন ভারসাম্য থাকে তখনই হাড়টা ঠিক থাকে। এর মধ্যে ক্লাসিকের কার্যক্রম যখন বেড়ে যাবে, অর্থাৎ ক্ষয় হওয়াটা যখন বেড়ে যাবে তখনই সমস্যা হবে।urgentPhoto
দেখা যায়, আমাদের বয়স যখন ৪০ তখন পর্যন্ত হাড় গঠন হয়। এর জন্য আমরা বলি বয়স ৪০ হওয়ার আগে যতটুকু পারা যায় হাড়কে গঠন করে নিতে হবে। এ জন্য আমরা এ সময় ব্যায়ামের কথা বলি। খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার রাখার কথা বলি। কারণ ৪০ বছর বয়সের পরে যখন হাড় ক্ষয় শুরু হবে তখন যেন তেমন সমস্যা না হয়।
এ ছাড়া হরমোনাল কিছু কারণে এই সমস্যা হয়। যেটা নারীর ক্ষেত্রে খুবই প্রচলিত। নারীর যখন মনোপোজ হয় অর্থাৎ মাসিক যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন শরীরে একটি হরমোন তৈরি হওয়া কমে যায়। ওই হরমোনটা অস্টিওব্লাস্টি কার্যক্রমকে বাড়িয়ে দেয়। যখনই এই হরমোনের পরিমাণটা কমে যায় তখনই হাড় ক্ষয় হওয়ার পরিমাণটা বেড়ে যায়। বলা হয়, যখন মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তার ১০ বছরের মধ্যে হাড়ের যে শক্তি ছিল তার ৩০ শতাংশ কমে যায়। তাদের হাড় ক্ষয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। যখন হাড়ে শক্তিটা ক্ষয় হয়ে যায় তখণ অল্প আঘাতে দেখা যায় হাড় ভেঙে গেছে।
আর কিছু বিষয় আছে এগুলোর কারণেও হয়। যেমন : মাদকগ্রহণ, মদ্যপান এগুলোর কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। এমনকি কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অস্টিওপরোসিস হয়ে থাকে। যেমন অমিপ্রাজল, গ্যাসট্রিকের ওষুধ, এটাও যদি দীর্ঘদিন খাওয়া হয় তবে অস্টিওপরোসিস হতে পারে। এজন্য এই ওষুধগুলো খাওয়ার কিছু নিয়ম আছে, সময় আছে। এগুলো অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।
এ ছাড়া আরো কিছু ওষুধ আছে, হাঁপানির, ত্বকের রোগ সোরিয়াসিসের কিছু ওষুধ, আরো কিছু ইনজেকশন স্টেরয়েড- এগুলো যারা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে তাদের এই সমস্যা হতে পারে।
আমরা কিছু রোগী পাই যারা হয়তো দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খায়। এটি দীর্ঘদিন খাওয়ার কারণে তাদের পৃষ্ঠদেশ ক্ষয় হয়ে যায়, মেরুদণ্ডে সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : অস্টিওপরোসিসের চিকিৎসায় কী করতে হয়?
উত্তর : চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত তাদের বিশ্রাম নিতে বলি, ব্যথার ওষুধ দিই। আর কিছু পরীক্ষা করে রোগটি নিশ্চিত হই। পরীক্ষা করে দেখি ক্ষয়টা কী ধরনের । যদি ক্ষয় দেখে মনে হয় আরো কিছু পরীক্ষা করা প্রয়োজন তখন এমআরআই করি। এমআরআই করে যদি দেখি ক্ষয় হয়ে অনেকটা অংশ চুপসে গেছে, কিন্তু পেছনে যে নার্ভ আছে তার উপর চাপ দেয় না। যদি নার্ভের দিকে চাপ থাকে এবং পায়ের দিকে ব্যথা যায় তবে এটাকে কেটে অস্ত্রোপচার করে নার্ভটাকে মুক্ত করে দিতে হয়। আর যদি পরিমাণ ছোট হয়ে থাকে আর খুব বেশি ব্যথা হয়, এর জন্য আধুনিক চিকিৎসা হলো ভার্ডিওপ্লাস্টি বা কাইফোপ্লাস্টি। এই জিনিসটি আমরা অস্ত্রোপচারের ঝক্কি ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে করতে পারি। এখানে যা করা হয়, যেই হাড়টা ভেঙে ছোট হয়ে গেছে, বসে গেছে, সেখানে একটি বিশেষ যন্ত্র ঢুকিয়ে দেই এবং বিশেষ পদ্ধতিতে একটি মেডিসিন ঢোকানো হয়, সেটা হলো বোন সিমেন্ট। এটি যখনই ভেতরে যায় তখন ওই হাড়টি শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথাও কমে যায়।
প্রশ্ন : কোন রোগীর ক্ষেত্রে এই ভার্টিওপ্লাস্টি চিকিৎসা করা হয়?
উত্তর : রোগ নির্ণয় করতে হবে এমআরআই করে। যদি তার নার্ভের ওপরে চাপ না থাকে এবং পায়ের দিকে যদি ব্যথা না যায়, কিন্তু তীব্র ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা ভার্টিওপ্লাস্টি করতে পারি। যদি নার্ভের ওপর চাপ থাকে তবে মাংস কেটে ভেতরে গিয়ে নার্ভটাকে পরিষ্কার করি এবং স্ক্রু দিয়ে ফিক্স করে দেই।
আর যাদের অল্প ভাঙে তাদের জন্য ভার্ডিওপ্লাস্টি। আর একটু বেশি ভাঙলে তাদের জন্য কাইফোপ্লাস্টি করা হয়। এখানে বাঁকা মেরুদণ্ডটাকে সোজা করা হয়। একটি বিশেষ যন্ত্র দিয়ে আমরা হাড়ের ভেতরে ঢুকাই। এর ভেতরে একটা বেলুন থাকে। এখানে আমরা চাপ প্রয়োগ করি। এই চাপে বেলুনটা ফুলে যায়। ফুলে গেলে যেই হাড়টা বসে গিয়েছিল সেটা বড় হয়ে যায়। তখন ভেতরে যে ক্ষয় হয়, সেটি আমরা সিমেন্ট দিয়ে পূরণ করে দেই। ভার্টিওপ্লাস্টি আর বেলুন কাইফোপ্লাস্টির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ভার্ডিওপ্লাস্টি এটাকে দৃঢ় করে। আর কাইফোপ্লাস্টি হলো যে উচ্চতাটা হারিয়ে গিয়েছিল সেটাকে ঠিক করে। কুজো হয়ে যাওয়া ঠিক করে দেয়।
প্রশ্ন : চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি রোগীর জন্য পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : আমরা সব সময় একটি বিষয় বলে থাকি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। এই অসুখটি যাতে না হয় সেদিকে আমরা নজর দিতে বলি। ৪০ বছরের আগে হাড় ভালোভাবে গঠন করুন। ৪০ পার হওয়ার পর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান, ব্যায়াম করুন এবং চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ নিন। যেসব কাজে ঝুঁকি আছে, হাড় ভেঙে যেতে পারে সেগুলো এড়িয়ে যান। এসব নিয়ম মেনে চললে আমরা এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারি।