কীটনাশক ব্যবহারে অসচেতনতায় কমতে পারে প্রজনন ক্ষমতা

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষিতে কর্মরত। আর মোট জিডিপির প্রায় ১৪ শতাংশ কৃষি থেকে। তবে শ্রমশক্তির এই বড় অংশটি রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। জমিতে কীটনাশক প্রয়োগসহ নানাবিধ সচেতনতার অভাবে কৃষকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে। কীটনাশক ব্যবহারে অসচেতনতা এবং এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে ক্যান্সার, পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, নারীদের অকাল গর্ভপাতসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষেত-খামার পরিদর্শন করে দেখা যায়, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের সময় কৃষকদের কেউই মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক পরিধান করছেন না। প্রাথমিক অবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব দেখা না গেলেও ধীরে ধীরে স্নায়ু, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় গলাচিপা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নূর উদ্দিনের সাথে। তিনি জানান, কীটনাশকের গ্যাস বা বাষ্প শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসে সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, কাশি ইত্যাদি সৃষ্টি করতে পারে। কীটনাশক ত্বকে লাগলে এলার্জি, চুলকানি, ফুসকুড়ি, এমনকি চর্মরোগও হতে পারে। চেখে গেলে জ্বালাপোড়া, লাল হয়ে যাওয়া, এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, স্মৃতিভ্রমও হতে পারে।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী কীটনাশক ব্যবহারে প্রভাবে ক্যান্সার, পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। ঘটতে পারে নারীদের অকাল গর্ভপাত।
ডা. নূর উদ্দিন বলেন, কিছুদিন আগে আমার হাসপাতালে একজন রোগী আসে। তিনি একজন প্রান্তিক কৃষক। আগের দিন সকালে জমিতে কীটনাশক ছিটিয়েছেন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে। দুপুরে দিকে অসুস্থ হয়ে যান, পরের দিন হাসপাতালে আসার পর মৃত্যু হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি স্ট্রোক করেছেন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা মাঠপর্যয়ে কৃষি স্কুলগুলোতে কীটনাশক ব্যবহারবিধি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের সচেতনার জন্য বলা হয়। কীটনাশক প্রয়োগের সময় তারা যেন মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও শরীরে ইউনিফরম (স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক) পরিধান করে, তা বলা হয়।
এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো অনুদান বা উপকরণ দেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সচেতন করা হয়। কিন্ত কোনো অনুদান দেওয়া হয় না।
প্রান্তিক কৃষকেরা সচেতন না হলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পড়তে পারেন। এ কথা সরাসরি বলতে পারব না, কারণ এমন কোনো রিসার্চ নেই আমাদের।
ফরিদপুর উপজেলা কৃষি অফিসার আনোয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইকে বলেন, আমরা সাধারণত কৃষকদের এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করি। তাদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। বাস্তবতা হচ্ছে, সব কৃষক এ নিয়ম মানতে চান না। তবে কেউই যে মানেন না তা আবার নয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন শাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সময় এসেছে আমাদের কৃষকদের সচেতন করার। কারণ কৃষকই আমাদের দেশের প্রাণশক্তি। কীটনাশক ব্যবহারে তাদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণসহ সচেতন করে তুলতে হবে। বিধি না মেনে দীর্ঘদিন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষকদের ক্রোমোজোম (ডিএনএ) কাজ না করতে পারে। ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে। ধরুন, বোনম্যারো বা অস্থিতে (যেখান থেকে রক্ত তৈরি হয়) আঘাত বা ক্রোমোজোম কাজ না করলে তার রক্ত তৈরি হবে না। ফলে দেখা দেবে রক্তশূণ্যতা। আবার মূত্র থলিতে বা ক্রোমোজোম কাজ না করলে সেখানে সমস্যা হতে পারে। ঠিক একইভাবে একজন পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যেতে বা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন কিটনাশক বিধি না মানলে।
ডা. সালাহউদ্দিন শাহ বলেন, তাই আমরা বলতে পারি আমাদের সচেতন হতে হবে। কৃষকদের বাচাতে হবে।
উপজেলা কৃষি অফিসগুলো থেকে নিবন্ধিত কৃষকদের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ বিধির প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা খুবই কম। আবার যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারাও কাজ করছেন না ঠিকমতো।
এ বিষয়ে ঢাকা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ডা. শওকত আলী বলেন, কীটনাশকের প্রভাবে স্বাস্থ্য ক্ষতি হচ্ছে এমন রোগী আমরা অহরহ পেয়ে থাকি। কীটনাশক প্রয়োগের সময় যদি মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস না থাকলে ওই কীটনাশক কৃষকের মুখ ও নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে রক্তের সঙ্গে মিশে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, স্নায়ুবিকল্য, মাথাব্যথাসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত করছে।
অন্যদিকে কৃষকদের অভিযোগ কৃষিকর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দেশে বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের দাবি, তারা এ ধরনের তেমন কোনো নিয়ম সম্পর্কে অবগত না। কীটনাশক খারাপ, তাই মুখে কাপড় বেধে সনাতন নিয়মে দেই।
তাদের দাবি, আমাদের সচেতনতা প্রশিক্ষণসহ কীটনাশক ব্যবহারের পোশাক (মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও শরীরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক) যেন উপজেলা কৃষি অফিস থেকে দেওয়া হয়।